বঙ্গরঙ্গবিধায়িণী দুর্গা: সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা বাংলার নিজস্ব আয়োজন—শারদীয়া দুর্গাপূজা
(Note: This article has been jointly written by Subhadeep Saha and Dr Probal Roy Chowdhury as part of The Saborno Sangrahalay’s Durga Project.)
তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম্।
দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে সুতরসি তরসে নমঃ।
বেদাদি নিখিল শাস্ত্রে তাঁর তুল্য ঐশ্বর্য অন্যত্র দৃষ্ট হয় না। তিনি মূলা প্রকৃতি আবার লীলারঙ্গে, দেবগণের আদৃত আহ্বানে সমগ্র দেবলোকের শক্তিসমূহ থেকে উদ্ভূত এই মহিষমর্দিনী রূপ। সত্ত্বরজস্তমোগুণের আধার তিনি, আবার পৃথক গুণে তিনিই দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, এই ত্রিধামূর্তিতে বঙ্গহৃদয়ে অধিষ্ঠিতা। অযোনিজাতা হয়েও তিনি উমা, গিরিরাজদুহিতা। ত্রিগুণা, ষড়ৈশ্বর্যসম্পূর্ণা হয়েও তিনি বঙ্গের আদরের কন্যা। শরৎকালে শিবনিবাস থেকে তিনি আসেন মর্ত্যে, পিত্রালয়ে। ত্রিদিবসান্বিত মহাপূজায় তাঁরই সমাদর অনুষ্ঠিত হয়। আমরা বঙ্গগর্ভোৎসারিত, মহাভাগ্যবান, কোটিজন্মের সুকৃত কর্মের প্রভাবে বাৎসল্য ও শান্তরসমণ্ডিত এই মহাপূজায় অংশিন।
শারদীয়া দুর্গাপূজার ইতিহাস
বঙ্গে দুর্গারাধনার প্রাচীনত্বের সঠিক ইতিহাস বর্তমানে অবগুণ্ঠিত। কালে-কালে নানান ধর্ম-প্রচারকরা এসে বাংলার এই আদি উপাসনার ইতিহাসকে বিকৃত করে রেখে গেছেন। বঙ্গদেশকে দুর্বল করতে তাঁরা শক্তি-উপাসনা ও শাক্ত সংস্কৃতির ধারাটি বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছেন বলেই আমাদের ধারণা। কিন্তু মহামায়ার পদধ্বনি এই বঙ্গে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ শারদীয়া মহাপূজা। মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবী-ভাগবতম্, কালিকাপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ, বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ প্রভৃতী পুরাণ-প্রমাণানুযায়ী মৃন্ময়ী প্রতিমাতেই বঙ্গে ত্রিদিবসীয় মহাপূজা সাড়ম্বড়ে প্রতিপালিত হয়। দুর্গা উপাসনার প্রাচীনত্বের প্রসঙ্গে, প্রাপ্ত নিদর্শন হিসেবে আমরা পালযুগের মহিষমর্দিনী চণ্ডীমূর্তির উল্লেখ করতে পারি। পালযুগেই মহীপাল নির্মিত দুর্গা মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব চারশোর কাছাকাছি সময়ে গড়ে ওঠা বাংলার প্রাচীনতম সভ্যতা ‘চন্দ্রকেতুগড়’-এ দশপ্রহরণধারিণীর মূর্তি পাওয়া গেছে। বর্তমানে যে মহাপূজা ঘটমান, তাতে অবদান রয়েছে এক বাঙালি কবির, কৃত্তিবাস ওঝা। তাঁর অনূদিত সুললিত পয়ারবদ্ধ রামায়ণে আমরা উল্লেখ পাই শারদীয়া মহাপূজার, যেমনটি আজও ঘটে চলেছে, ঠিক তেমনই। মূল বাল্মীকি রামায়ণে শ্রীরামের দুর্গাপূজার উল্লেখ না থাকলেও কৃত্তিবাস নানা শাস্ত্রপ্রসঙ্গ ও লৌকিক কথায় প্রভাবিত হয়ে শ্রীরামকে দিয়ে রাবণবধের উদ্দেশে শরৎকালীন মহাপূজা করিয়েছেন। কবি কৃত্তিবাসের স্বকপোলকল্পিত অলীক ভাবনা নয় এই আরোপ। বিল্ববৃক্ষমূলে অকালবোধন, কল্পারম্ভ, অষ্টোত্তরশত মৃণালার্চনা—এ-সবই কৃত্তিবাসী রামায়ণে উল্লিখিত রয়েছে। আধুনিক কালে বঙ্গীয় মহাপূজার বিবর্তনের ইতিহাস রচিত হয়েছে, পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী পরগণার তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের হাত ধরে। মুঘল শাসক আকবরের আমলে বহু লক্ষ টাকা ব্যয়ে তিনি দুর্গাপূজা করেছিলেন বলে জানা যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সদর কৃষ্ণনগরে রাজরাজেশ্বরী দুর্গার শারদীয়া মহাপূজা প্রবর্তন করেছিলেন। বলাই বাহুল্য, এই দুর্গাপূজা বিস্তার ও প্রসার লাভ করে ছোট ছোট অঞ্চলে, গ্রামে, নগরে, জমিদারিতে। এই ভাবেই শাস্ত্রবর্ণিত মহাপূজার পুনরুদ্ধার হয়। কলকাতা শহরে রাজা নবকৃষ্ণ নবনির্মিত শোভাবাজার রাজবাটিতে প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। আজও সেই পূজা-পরম্পরা অক্ষত। কলকাতায় আরো কিছু প্রাচীন বনেদি বাড়িতেও পূজার প্রচলন হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বড়িশার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের প্রাণকেন্দ্র রাজধানী কলকাতায় দুর্গাপূজার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। আজও দু্র্গাপূজা কিঞ্চিৎ কলকাতা-কেন্দ্রিকই হয়ে রয়েছে। কিন্তু এর প্রাচীনতা লুকিয়ে আছে আরও গভীরে, বাংলার পল্লিতে-পল্লিতে, নানান ইতিহাসে, নানান আচার-অনুষ্ঠানে। অষ্টাদশ শতাব্দীর টেরাকোটা মহিষমর্দিনী সে-সাক্ষ্যই বহন করে। মৃন্ময়ী দুর্গাপ্রতিমা পূজার ইতিহাসও হাজার বছরের বেশি প্রাচীন। জীকন, বালক, শ্রীকর, জীমূতবাহনের মতো স্মৃতি-নিবন্ধকারদের রচনায়, নশো বছর আগে কবি ভবদেব ভট্টের রচনায়, এবং চৈতন্য-সমসাময়িক রঘুনন্দনের রচনায়ও মাটির প্রতিমা গড়ে পুজোর কথা বলা হয়েছে। মৈথিলি কবি বিদ্যাপতি রচনা করেছিলেন ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’, আজও কলকাতার বড়িশার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারে সেই গ্রন্থের আনুগত্যে পূজা হয়ে আসছে। বেদ-পূর্ববর্তী অধ্যায়েও মাতৃকা-উপাসনার কথা এখন সুবিদিত। বেদেও অগ্নিবর্ণা, অগ্নিলোচনা দেবী দুর্গার উপাসনা পাওয়া যাচ্ছে। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতে, বৈদিক শরৎ-ঋতুসূচক যে যজ্ঞ, তা-ই বঙ্গে তন্ত্রপ্রভাব মিশ্রিত হয়ে শারদীয়া মহাপূজার রূপ ধারণ করেছে। দুর্গাপূজা যে যজ্ঞতুল্য, তার প্রমাণ পূজার বিভিন্ন মন্ত্রেই স্পষ্ট। এছাড়াও দেবীপুরাণে বলা হচ্ছে, ‘অশ্বমেধমবাপ্নোতি ভক্তিনা সুরসত্তম। মহানবম্যাং পূজেয়ং সর্ব্বকামপ্রদায়িকা॥’ অর্থাৎ, দুর্গাপূজাকে বৈদিক অশ্বমেধযজ্ঞের সমমাহাত্ম্য দেওয়া হয়েছে। দ্বাদশ শতাব্দীতে বাঙালি স্মৃতিকার শূলপাণি রচনা করেছিলেন দুর্গাপূজা সম্পর্কিত তিনটি স্মৃতি-সংকলন। অন্যদিকে শুধু কৃত্তিবাস নয়, দ্বাদশ শতাব্দীতেই সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’-এ উত্তরবঙ্গে শারদীয়া দুর্গাপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। বৃন্দাবন দাস ঠাকুরের চৈতন্যভাগবত গ্রন্থে পাওয়া যায়,
‘মৃদঙ্গ মন্দিরা শঙ্খ আছে সব ঘরে।
দুর্গোৎসব কালে বাদ্য বাজাবার তরে।।’
অর্থাৎ, চৈতন্য যুগেও বাঙালির দুর্গাপূজা উৎসবেরই নামান্তর ছিল। চৈতন্যসঙ্গী নিত্যানন্দ তাঁর শ্রীপাট খড়দহে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। আজও তাঁর বংশজরা সেই পূজার পারম্পর্য বহন করে চলেছে। আরও একটি বিষয়ে উল্লেখ করা প্রয়োজন, দুর্গামূর্তির বিবর্তনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, অনেক কটি স্তর পেরিয়ে আজকের এই সপরিবার দুর্গার মূর্তিকল্পটি বাংলার হৃদয়কমলে প্রতিভাসিত হয়ে রয়েছে। এই পরিবারসমন্বিত রূপটি কিন্তু বাংলার নিজস্ব ভাবনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকাল পর্যন্ত বাংলার পরিবারে যে এক অন্নের অনুবর্তন চলে এসেছিল , তা’ই ভগবতী দুর্গাকে এক চালচিত্রে বেঁধে ফেলেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মহিষমর্দিনী দুর্গা যেমন প্রাচীনকালে যুদ্ধের দেবী হয়ে অনুপ্রেরণা দান করেছেন, তেমনই অদূর অতীতে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদের চেতনা জুগিয়েছে। মহাভারতের মহারণে মহাসন্ধিক্ষণে পুরুষোত্তম কৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন করেছিলেন দেবী দুর্গার স্তুতি, “নমস্তে সিদ্ধসেনানি আর্যে মন্দারবাসিনি!” তাই তো ঋষি বঙ্কিম রচনা করেছিলেন ‘বন্দেমাতরম্’ মন্ত্র। তাতে বলা হল, ‘ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী, কমলা কমলদল বিহারিনী, বাণী বিদ্যাদায়িনী’। যে গান হাজার-হাজার বিপ্লবীর বুকে স্বদেশচেতনার আগুন জ্বালিয়ে দিল, সেই গানে বঙ্কিম বেঁধে দিলেন সেই সুপ্রাচীন ইতিহাসকে, যে ইতিহাসের ব্যাপ্তি বেদভূমিকেও ছাড়িয়ে আরও অতীতে প্রসারিত।
দুর্গা—বাংলার কাব্যে ও সাহিত্যে
দুর্গা এবং দুর্গাপূজা, সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে বাংলার শাক্ত পদাবলীকে। কবিরঞ্জন শ্রীরামপ্রসাদ সেন শাক্তপদাবলী সাহিত্যে এক নতুন আঙ্গিক সৃষ্টি করেছিলেন। বীররসের শাক্তপদাবলীতে তিনি বাৎসল্য রসের সঞ্চার করেছিলেন। ফলে মহামায়া হয়ে উঠেছেন কন্যার মতো, ঘরের মেয়ের মতো। এই ভাবই আগমনী সাহিত্যের জন্ম দিয়েছে। আগমনী গানের বিষয়বস্তু উমার পিত্রালয়ে আগমন ও তৎসংক্রান্ত ঘটনাপরম্পরাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। উমার পিতৃগৃহে আগমন নিয়ে আগমনী ও কৈলাসে গমন নিয়ে বিজয়া গান রচিত হয়েছে। দেবী ভাগবত, কালিকা পুরাণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী, দক্ষযজ্ঞে সতী দেহত্যাগ করলে শিব বহুকাল একাকী ছিলেন। পর্বতরাজ হিমালয়ের গৃহে সতী উমারূপে জন্মগ্রহণ করেন। পরে কঠোর তপস্যা করে শিবের অটল প্রতিজ্ঞাকে টলিয়ে তিনি শিবকে পতিপদে বরণ করেন। এই উমা পর্বতকন্যা, তাই পার্বতী। এ-সবই পৌরাণিক আখ্যান। লোককল্পে, দশভুজা মহিষমর্দিনী দুর্গা আর উমা এক হয়ে গেছেন। শিব-পার্বতীর বিবাহ হল ধুমধাম করে। বিয়ের দিন বুড়ো শিবকে দেখে পাড়া-প্রতিবেশী শাশুড়িকে বলে, “মেনকা মাথায় দে লো ঘোমটা!” ‘ভাঙর ভিখারি জামাই’ দেখে মেনকা চেতনা হারান। পরে শিব মদনমোহন রূপ ধরলে পার্বতীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বাংলা লোকসংগীতে ও বারাণসী ঘরানায় শিববিবাহের বহু গান রচিত হয়েছে ও গীত হয়। আমাদের একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতিতে বিবাহের সময় যখন ‘নাপিতের বচন’ অনুষ্ঠিত হয়, তখন সেখানেও থাকে শিব-পার্বতীর বিয়ের কথা। এখন, বিয়ে তো হল, কিন্তু জামাইয়ের অমন ভোলা আশুতোষ রূপ দেখে কোন্ মেয়ের মা ঠিক থাকতে পারেন! মেয়ের সাংসারিক দুর্দশার কথা চিন্তা করে মা মেনকা মরমে মরে রইলেন। বৎসর গেল। শরৎকালের এমনই এক শুভ্রসুন্দর দিনে মা মেনকা গিরিকে বলেন, “কুস্বপন দেখেছি গিরি, উমা আমার শ্মশানবাসী” (গিরিশচন্দ্র ঘোষ)। মায়ের মনের কু-ডাক আর বাধা মানে না। মেনকা এখন উমার কালীরূপ মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন। রাজার মেয়ে উমা বুঝি শ্মশানচারী শিবের সঙ্গিনী হয়ে, শ্মশানে মশানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। “…এলোকেশী বিবসনা, উমা আমার শবাসনা, ঘোরাননা ত্রিনয়না, ভালে শোভে বালশশী।” দুর্গা, কালী প্রভৃতী একই মহাশক্তির বিভিন্ন রূপ, কবি এমন করেই বুঝিয়ে দিলেন গানে গানে। কিন্তু মাতৃহৃদয় দেবত্ব মানে না, মহাশক্তি তাই মায়ের কাছে সাধারণী উমা। তিনি গিরিকে অনুযোগ করে বলেন,
“গৌরী দিয়ে দিগম্বরে, আনন্দে রয়েছ ঘরে,
কি আছে তব অন্তরে না পারি বুঝিতে।
কামিনী করিল বিধি, তেঁই হে তোমারে সাধি,
নারীর জনম কেবল যন্ত্রণা সহিতে!” (কমলাকান্ত)
—মেয়ের বিয়ে দিয়েই সব দায়িত্ব শেষ তোমার? মেয়ে আমার ঐ উলঙ্গ শিবের হাতে বাঁচল না মরল, একবারও খোঁজটুকু নিতে নেই! বিধি আমায় নারী করেছে, আমার শুধু তোমার হাতে-পায়ে সাধাই কাজ, তাই না! নারীজন্মই তো কেবল যন্ত্রণা ভোগ করার জন্য! চিরন্তন শ্লেষ, বাংলার ঘরে ঘরে কান পাতলেই এমন কথার টান শোনা যায়। আর কী বলল মেনকা,
“সতিনী সরলা নহে, স্বামী সে শ্মশানে রহে,
তুমি হে পাষাণ, তাহে না কর মনেতে।
কমলাকান্তের বাণী, শুন হে শিখর মণি,
কেমনে সহিব এত মায়ের প্রাণেতে।।” (কমলাকান্ত)
সতিনের ঘর করে উমা। সতীন মানে গঙ্গা। সে মোটেই সরলা নয়; স্বাভাবিক, নদী কখনও সরলগতিতে চলতে পারে! একে সতিনের ঘর, তায় আবার স্বামী শ্মশানচারী। তুমি তো পাষাণ, কেমন করে বুঝবে এসব? হিমালয় তো ‘পাষাণ’-ই হবে! কমলাকান্ত বলছে, হে পর্বত শ্রেষ্ঠ, মায়ের প্রাণে কেমন করে এসব সয়। তাই এখন কী কর্তব্য—
“যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী, উমা বড় দুখে রয়েছে।
দেখেছি স্বপন, নারদ বচন, উমা মা মা বলে কেঁদেছে।।”
শুধু উমাকে আনলেই হবে না। এবার এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন আর কখনও উমাকে ফিরতে না হয়। তাই রামপ্রসাদ লিখলেন,
“গিরি, এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাব না।
বলে বলবে লোকে মন্দ, কারো কথা শুনবো না।।”
যে স্বামী ঘরের চিন্তা করে না, তার কাছে আর না ফেরাই ভালো। মেনকার মনে এমনই বাসনা। ‘পাষাণ’ গিরিরাজ উত্তর করেন,
“বারে বারে কহ রাণী, গৌরী আনিবারে,
জানতো জামাতার রীত অশেষ প্রকারে।
বরঞ্চ ত্যাজয়ে মণি ক্ষণিক বাঁচয়ে ফণী,
ততোধিক শূলপাণি ভাবে উমা-মা’রে—
তিলে না দেখিলে ঘরে, সদা রাখে হৃদিপরে,
সে কেন পাঠাবে তারে সরল অন্তরে।” (কমলাকান্ত)
অন্যদিকে শিবের ঘরে অন্য পরিবেশ তখন। ভিখারি হলেও ভালো তো বাসে শিব প্রাণের চেয়েও বেশি পার্বতীকে। একবার যাকে হারিয়েছে, তাকে কি আর হাতছাড়া করতে চায়? তাই সেখানেও চলছে সাধাসাধি—
“তোমারি কারণে কঠিন পরাণে সম্বৎসর ভুলে আছি হে মায়েরে,
যাব পিতৃঘর শুন প্রাণেশ্বর অনুমতি কর দিনত্রয় তরে।” (স্বামী তপানন্দ)
মাত্র তিনদিনের তো ব্যাপার, তারপরেই ফিরে আসব। এই কথা দিয়ে উমা চার ছেলেমেয়ে আর জয়া-বিজয়া দুই সখীকে নিয়ে রওনা হয় মর্ত্যের উদ্দেশ্যে। হরগৃহে নেমে আসে আঁধার, মর্ত্যে বেজে ওঠে ঢাকের বোল। উমার আগমনের সংবাদ পৌঁছায় মেনকার কানে। মেনকার ঘুম আর আসে না—
“নিদ্রা নাহি আসে, উঠে আর বসে, চেয়ে দেখে নিশি পোহাল কিনা।
যা শুনে শ্রবণে সবই হয় মনে ঐ বুঝি উমা এসে ডাকে মা!”
…সখী বলে স্থির হও গিরিরাণী, দুখহরা দুর্গা আসিবে এখনি
প্রভাত প্রায় নিশা, হল বলে উষা, করি বেশভূষা আনিবে চল না।” (স্বামী তপানন্দ)
মায়ের চোখে সারারাত্রির জাগরণে তন্দ্রা লেগে আসে। তখনই এসে পড়ে উমা। পাঁচালিকার দাশরথি রায় ব্যস্তসমস্ত হয়ে ডাকেন মেনকাকে—
“গা তোল্ গা তোল্ বাঁধ মা কুন্তল,
ঐ এল পাষাণী, তোর ঈশানী।
লয়ে যুগল শিশু কোলে, ‘মা কৈ মা কৈ’ বলে,
ডাকছে মা তোর শশধরবদনী!” (দাশরথি রায়)
গিরিরাজ পাষাণ তাই গিরিরাণী ‘পাষাণী’। বাড়িতে ঢুকলেই যেমন ছেলেমেয়েরা আগে ‘মা কোথায়’ বলে হাঁক পাড়ে, উমাও কি তার ব্যতিক্রম! কিন্তু এ কী! মা যে এই দশভুজা রূপ দেখে তার আদরের ছোট্ট উমাকে চিনতেই পারে না! আদরের মেয়ে, যাকে জল গড়িয়ে খেতে হত না, সে যদি সংসারী হয়ে যায়, তখন মা অবাক হয়ে যান, মেলাতে পারেন না। তাই, মেনকার হয়ে তারাচাঁদ বললেন,
“করী অরি পরে আনিলে হে কারে, কৈ গিরি মম নন্দিনী,
আমার অম্বিকা দ্বিভুজ বালিকা, এ যে দশভুজা ভুবন মোহিনী।
কিবা সে দক্ষিণে গজেন্দ্র-বদন, প্রকাশিত যেন প্রভাতী তপন,
ষড়ানন স্ববামেতে সুশোভন, কমলা ভারতী সহকারিণী।
দক্ষিণাঙ্গ রাখি মৃগেন্দ্র পরেতে আর পদ আরোপিয়ে অসুরেতে,
দাঁড়িয়ে আছেন কিবা ত্রিভঙ্গ ভঙ্গীতে জ্ঞান হয় পূর্ণ ব্রহ্মসনাতনী।
শুনেছি পুরাণে ওহে গিরিবর, এই রূপ আরাধিয়ে রঘুবর,
বরদার বরে জয়ী লঙ্কেশ্বর, উদ্ধারিয়েছিলেন জনকনন্দিনী।
তারাচাঁদ কহে শুন গিরিরাণী, এই সেই তোমার পরাণ ঈশানী।
নাশিতে ভূভার দশভুজাকার মহীতে মহিষাসুরমর্দিনী।” (তারাচাঁদ)
এই একটি গানে দুর্গার রূপের সামগ্রিক আভাস পাওয়া গেল। উমা আর দুর্গা এক হলেন। বেলা গড়িয়ে গেল মায়ের ঘোর কাটতে। সন্ধ্যা হয় হয়, বিল্ববৃক্ষের নীচে গণেশকে আগে বসিয়ে মা উমাকে বরণ করলেন, “বসিলেন মা হেমবরণী, হেরম্বে ল’য়ে কোলে। হেরি গণেশ-জননী-রূপ, রাণী ভাসেন নয়ন-জলে।”
“গিরি গণেশ আমার শুভকারী৷
পূজে গণপতি পেলাম হৈমবতী
চাঁদের মালা যেনা চাঁদ সারি সারি৷
বিল্ববৃক্ষ মূলে পাতিয়া বোধন
গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন৷
ঘরে আনব চণ্ডী, কর্ণে শুনব চণ্ডী
আসবে যত দণ্ডী, জটাজুট-ধারী৷
মেয়ের কোলে মেয়ে দুটি রূপসী
লক্ষ্মী-সরস্বতী শরতের শশী৷
সুরেশ কুমার গণেশ আমার
তাঁদের না দেখিলে ঝরে নয়নবারি৷” (দাশরথি রায়)
মেয়ে বাপের বাড়ি এসে একটু ধাতস্থ হলে মা ধীরেসুস্থে শ্বশুরবাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে, এমনটাই দস্তুর। তার আগে প্রাণ আইঢাই করলেও সহজে জিজ্ঞেস করে উঠতে পারে না।
“কেমন করে হরের ঘরে ছিলি উমা বল মা তাই।
কত লোকে কতই বলে শুনে প্রাণে মরে যাই।।
মার প্রাণে কি ধৈর্য ধরে, জামাই নাকি ভিক্ষা করে।
এবার নিতে এলে পরে বলব উমা ঘরে নাই।।
চিতাভস্ম মাখে অঙ্গে জামাই ফেরে নানা রঙ্গে।
তুই নাকি মা তাঁরই সঙ্গে সোনার অঙ্গে মাখিস ছাই।।” (গিরিশচন্দ্র ঘোষ)
মায়ের কথা শুনে মেয়ে হেসে ওঠে। বলে, মা তুমি তো আর আমার খোঁজ নাওনি… কেমন করে জানবে আমি কেমন ছিলাম? ভোলা পাগল হতে পারে, কিন্তু সে কি আমায় কম ভালোবাসে!
“তুমি তো মা ছিলে ভুলে আমি পাগল নিয়ে সারা হই,
হাসে কাঁদে সদাই ভোলা, জানে না মা আমা বই!” (গিরিশচন্দ্র ঘোষ)
কথায় কথায় আদরে সোহাগে নবমী ঘনিয়ে আসে। উমার বিদায়বেলা কাছে আসতেই গিরিপুরী স্তব্ধ হয়ে যায়। যে মেনকা এতদিন ধরে শিবের নিন্দা করছিল, আজ বিদায়বেলা ঘনাতেই সুর বদলে গেল। এবার চাইছে যেন শিব ঘরজামাই হয়ে থাকে গিরিপুরে।
“আমার মনে আছে এই বাসনা—
জামাতা সহিতে, আনিব দুহিতে,
গিরিপুরে করব শিবস্থাপনা।” (অজ্ঞাত)
(https://www.youtube.com/watch?v=6bccY9hNRUI)
সকলে মিলে উমাকে অনুরোধ করে, যেন আর কটা দিন থেকে যায়। এবার আর ‘আগমনী’ নয়। শুরু হল ‘বিজয়া’-র গান। উমার মন আর টেকে না, পাগল ভোলার জন্য উতলা হয়ে গেছে সে। সকলে মিলে বলে,
“এসেছিস মা, থাক্ না উমা দিনকতক,
হয়েছিস ডাগরডোগর, এখন কিসের ভয় এত।”
উমাকে এত বলেও থাকার জন্য রাজি করানো গেল না। নবমীর নিশি এল। মায়ের কান্নার রোলে ভারী হল গিরিপুরী। কমলাকান্ত লিখলেন,
“ওরে নবমী-নিশি, না হইও রে অবসান।
শুনেছি দারুণ তুমি, না রাখ সতের মান॥” (কমলাকান্ত)
মধুকবি লিখলেন,
““যেয়োনা, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে!
গেলে তুমি দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে!
উদিলে নির্দয় রবি উদয়-অচলে
নয়নের মণি মোর নয়ন হারাবে!
বার মাস তিতি, সত্যি, নিত্য অশ্রুজলে,
পেয়েছি উমায় আমি! কি সান্ত্বনা-ভাবে—
তিনটি দিনেতে, কহ, লো তারা-কুন্তলে,
এ দীর্ঘ বিরহ-জ্বালা এ মন জুড়াবে?
তিন দিন স্বর্ণদীপ জ্বলিতেছে ঘরে
দূর করি অন্ধকার; শুনিতেছি বাণী—
মিষ্টতম এ সৃষ্টিতে এ কর্ণ-কুহরে!
দ্বিগুন আঁধার ঘর হবে, আমি জানি,
নিবাও এ দীপ যদি!” – কহিলা কাতরে
নবমীর নিশা-শেষে গিরীশের রাণী।” (মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
দশমী প্রভাতে উমার বিধুমুখ দেখে রাণী নয়নজলে ভাসেন। কমলাকান্ত গাইলেন,
“ফিরে চাও গো উমা, তোমার বিধুমুখ হেরি,
অভাগিনী মায়েরে বধিয়ে কোথা যাও গো!
রতন ভবন মোর আজি হৈল অন্ধকার,
ইথে কি রহিবে দেহে এ ছাড় জীবন।”
উমা ফিরে যায়। কৈলাসে শোনা যায় পাগল ভোলার আনন্দডম্বরুর স্বর। আবার শুরু হয় একটা বছরের অপেক্ষা। আবার এক বছর পর শরতের নদী-ধান-মাঠ পেরিয়ে বাংলার পল্লিতে পল্লিতে বাউল-বোষ্টুম-বোষ্টুমিদের গলায় বেজে উঠবে আগমনী বার্তা। এই আগমনী বাংলার মাতৃহৃদয়ের গান। এর তুলনা কিছু নয়, অন্য কিছু নয়। আগমনী সাহিত্যের পূর্বে মঙ্গলকাব্যের ধারায়ও দু্র্গার প্রভাব রয়েছে। চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল জাতীয় কাব্যে প্রাচীন পল্লি বাংলার সঙ্গে ভগবতী একাত্ম হয়ে গেছেন। ভারতচন্দ্র ভগবতীর মহাপূজা প্রসঙ্গে লিখেছেন,
“শঙ্খঘণ্টারব মহামহোত্সব
ত্রিভুবন জয়জয়।
নাচিছে নটিক নাচিছে গায়ক
রাগ তাল মনে লয়।
যত চরাচর হরিষ অন্তর
পরম আনন্দময়।”
পরবর্তীকালে যাত্রায়, কবিগানে, পালায়, কীর্তনে, কবিতায় বারবার শরৎ ঋতু, উমা, এবং বাংলার সম্পৃক্ততা প্রকাশ পেয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ দুর্গাপূজা প্রসঙ্গে লিখেছেন, “আমাদের বাংলাদেশের এক কঠিন অন্তরবেদনা আছে—মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো। অপ্রাপ্তবয়স্ক অনভিজ্ঞ মূঢ় কন্যাকে পরের ঘরে যাইতে হয়, সেইজন্য বাঙালি কন্যার মুখে সমস্ত বঙ্গদেশের একটি ব্যাকুল করুণ দৃষ্টি নিপতিত রহিয়াছে। সেই সকরুণ কাতর স্নেহ বারংবার শারদোত্সবে স্বর্গীয়তা লাভ করিয়াছে। আমাদের এই ঘরের স্নেহ, ঘরের দুঃখ, বাঙালির গৃহের এই চিরন্তন বেদনা হইতে অশ্রুজল আকর্ষণ করিয়া লইয়া বাঙালির হূদয়ের মাঝখানে শারদোত্সব পল্লবে ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহা বাঙালির অম্বিকাপূজা এবং বাঙালির কন্যাপূজাও বটে। আগমনী এবং বিজয়া বাংলার মাতৃহূদয়ের গান।”
কাজী নজরুল ইসলামের বহু শাক্তগীতি ও কবিতার মধ্যে আগমনী ও বিজয়া সংক্রান্ত গানগুলি একদিকে যেমন অন্তরের চৈতন্যময়ী শক্তিকে জাগরুক করার কথা বলে, অন্যদিকে স্বদেশচেতনাতেও উদ্বুদ্ধ করে।
“যাসনে মা, ফিরে যাসনে জননী, ধরি দুটি রাঙা পায়,
শরণাগত দীন সন্তানে ফেলে রাখি ধরার ধুলায়।
আজও মরেনি অসুর, মরেনি দানব,
ধরণীর বুকে করে তাণ্ডব।
সংহার নাহি করি সে অসুরে কেন যাস বিজয়ায়?”
পূজার ধারা—বৈচিত্র্য ও বিশিষ্টতা
বঙ্গদেশে একমাত্র শারদীয়া দু্র্গাপূজাকেই মহাপূজার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মহাপূজা অর্থে, যে পূজায় পূজন, স্নপন, বলিদান ও হবন এই চারটি অঙ্গই অবিচ্ছিন্ন থাকবে। দুর্গাপূজায় পূজা তো আছেই, সঙ্গে রয়েছে নানান স্থানের জল-মাটি, পঞ্চগব্য-পঞ্চামৃত সহ নানান বিহিত দ্রব্যে মহাস্নান, প্রতিদিন বলিদান ও মহানবমীতে বেদোক্ত হোম। মোট সাতটি কল্পে দুর্গাপূজার বিধান আছে। তার মধ্যে প্রথমটি আশ্বিন কৃষ্ণানবমী, পরেরটি শুক্ল প্রতিপদ আর তৃতীয়টি শুক্লষষ্ঠী। কৃত্তিবাসী রামায়ণে শ্রীরামচন্দ্র ষষ্ঠী তিথিতেই ব্রহ্মার দ্বারা দেবীকে জাগ্রত করে মহাপূজার সূচনা করেন, তাই হয়তো বঙ্গদেশে ষষ্ঠীর সায়াহ্নের বোধনেরই প্রচলন বেশি। তবে এখনও কোথাও কোথাও কৃষ্ণানবম্যাদি কল্পারম্ভে পক্ষকালব্যাপী মহাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। ষষ্ঠীতেই অনুষ্ঠিত হয় দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস। সপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ, মৃন্ময়ী মূর্তির প্রাণপ্রতিষ্ঠা ও ঘটস্থাপন। নবপত্রিকা আদতে কৃষিজীবী বাংলার নিজস্বতা। নবপত্রিকা অর্থে নটি পাতা। নটি যথাক্রমে, কদলী বা রম্ভা (কলা), কচ্চ (কচু), হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মান ও ধান। একটি কলাগাছের মধ্যে ষষ্ঠীর সেই বোধনের বিল্ববৃক্ষের ফলযুগল এবং এই নয়টি পত্রিকা একত্রে বেঁধে তৈরি হয় নবপত্রিকা। প্রত্যেকটি পত্রিকার পৃথক পৃথক অধিষ্ঠাত্রী দেবতা আছেন— ১. রম্ভা – ব্রহ্মাণী, ২. কচ্চি – কালিকা, ৩. হরিদ্রা – দুর্গা, ৪. জয়ন্তী – কার্তিকী, ৫. বিল্ব – শিবা, ৬. দাড়িম্ব – রক্তদন্তিকা, ৭. অশোক – শোকরহিতা, ৮. মান – চামুণ্ডা ও ৯. ধান্য –মহালক্ষ্মী। প্রথমে নবপত্রিকাকে স্রোতজলে অবগাহন করিয়ে এনে পূজামণ্ডপের বহির্ভাগে এই মহাস্নান কর্তব্য। পরে সেখানেই নবপত্রিকাকে অপরাজিতা লতা দ্বারা বেষ্টন ও দেবীসাজে সুসজ্জিতা করে মণ্ডপে প্রবেশ করানো হয়—“চামুণ্ডে চল চল চালয় চালয় শীঘ্রং দুর্গে মম গৃহং প্রবিশ।” প্রাণপ্রতিষ্ঠাও একটি সুন্দর ভাবনার দ্যোতক। একটি প্রদীপ থেকে অন্য একটি প্রদীপ যেমন জ্বালানো হয়, আমাদের অন্তরের প্রাণ থেকেই দেবীমূর্তিতে প্রাণসঞ্চার করা হয়। কবিগুরুর ভাষায়, দেবী আমাদের চেতনার রঙে প্রাণবতী হন। মহাসপ্তমীতে দেবী ও গণেশের ঘটস্থাপন কর্তব্য আর মহাষ্টমীর দিন স্থাপিত হয় নবঘট। এই নবঘটের ধারণাটি আবার তন্ত্রশাস্ত্রে যন্ত্রের যে ধারণা, তার সঙ্গে কিছুটা মিলে যায়। একটি অষ্টদল পদ্মের আটটি দলে আটটি ঘট ও মধ্যে আরেকটি ঘট বসানো হয়। আটটি ঘটে যথাক্রমে দশভুজা দু্র্গার ধ্যানে বর্ণিত আটজন যোগিনীর পূজা হয়—
‘উগ্রচণ্ডা প্রচণ্ডা চ চণ্ডোগ্রা চণ্ডনায়িকা
চণ্ডা চণ্ডবতী চৈব চণ্ডরূপাতি চণ্ডিকা।’
আর মাঝখানের ঘটে পূজা হয় স্বয়ং অষ্টাদশভুজা মহালক্ষ্মীর। এখানেই শেষ নয়। উপরোক্ত আটজন মূল যোগিনীর প্রত্যেককে ঘিরে আবার আটজন করে যোগিনী থাকেন। সর্বমোট চৌষট্টি বা চতুঃষষ্ঠী যোগিনী, যার উল্লেখ বহু গ্রন্থে পাওয়া যায়। প্রজাপতি ব্রহ্মা প্রথম দেবীকে দর্শন করেছিলেন সালঙ্কারা কুমারীরূপে তাই মহাষ্টমী ও মহানবমীতে মূল পূজা শেষে আয়োজিত হয়, কুমারী পূজা। এক থেকে ষোলো বছরের কুমারীকে পূজা করাই বিধেয়, কিন্তু অকুসুমিত বালিকাই গ্রাহ্যা। বয়স অনুযায়ী, কুমারীর নামের প্রভেদ হয়ে থাকে। যে বয়সের কুমারী, সেই নামেই সম্বোধন করে পূজা হয়ে থাকে— ১. সন্ধ্যা, ২. সরস্বতী, ৩. ত্রিধামূর্তি, ৪. কালিকা, ৫. সুভগা, ৬. উমা, ৭. মালিনী, ৮. কুব্জিকা, ৯. অপরাজিতা, ১০. কালসন্দর্ভা, ১১. রুদ্রাণী, ১২. ভৈরবী, ১৩. মহালক্ষ্মী, ১৪. পীঠনায়িকা, ১৫. ক্ষেত্রজ্ঞা, ১৬. অম্বিকা। কুমারীর জাতিভেদ ঘোরতরভাবে নিন্দনীয়। কুমারী পূজা মূলত তান্ত্রিকী চক্র। বঙ্গদেশে কোথাও কোথাও সধবাপূজা এবং বঙ্গদেশের বাইরে সুবাসিনীপূজার মাধ্যমে বিবাহিতা নারীরাও পূজিতা হন।
মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে অষ্টাদশোপচারে হয় মহাশক্তি চামুণ্ডার পূজা, অষ্টোত্তরশত সংখ্যক পদ্মপুষ্প দান, অষ্টোত্তরশত দীপদান, বলিদান। কোথাও আবার অর্ধরাত্রিবিহিত পূজাও হয়। এগুলি সবই তন্ত্রোক্ত পূজা। মহানবমীর পূজার শেষে বেদোক্ত হোম, সরুধির বলিদান ও দক্ষিণান্ত সমাধা হলে মহাপূজার সমাপ্তি ঘোষিত হয়। বিজয়া দশমীতে শীতল ভোগ নিবেদন করে দেবীর দর্পণ বিসর্জন হয়। প্রতিমা নিরঞ্জনের আগে দেবীকে বরণ করা হয়, ঘরের মেয়ের মত তাঁর আঁচলে বেঁধে দেওয়া হয়, ফলমূল, মিষ্টি— রাস্তায় যেতে যেতে মা খাবেন। কনকাঞ্জলি শেষে দেবীর কানে কানে বলা হয়, “আবার এসো মা।” আগে প্রতিমার চালচিত্রে থাকত একটা নীলকণ্ঠ পাখি। সে উড়ে গিয়ে কৈলাসে খবর দেয়, মা আসছেন। নিরঞ্জনের পর অপরাজিতা পূজা হয়ে থাকে অনেক জায়গাতে।
দুর্গাপূজায় বৈদিকী, তান্ত্রিকী, পৌরাণিকী ও স্মার্ত পরম্পরা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। শুধু বাংলা কেন, গোটা ভারতবর্ষে সনাতন ধর্ম পরিচালিত কোনও উৎসবে বা পূজায় এমন বৈচিত্র্য আর নেই।
শারদীয়া মহাপূজার বর্তমান পরিভাষা
ইতিহাসের গতিপথ ক্রমবিবর্তিত হয়। কখনও সে বক্রগতি ধারণ করে, কখনও সরলগতিতে চলে। কালের নিয়মে শারদীয়া দুর্গাপূজা আরও প্রসার লাভ করেছে। নিখিল বঙ্গের প্রায় সর্বত্রই মহাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিশেষ করে মহানগরী কলকাতায় দুর্গাপূজা উপলক্ষে রাজকীয় মহোৎসব উদ্যাপিত হয়। ধর্ম, বর্ণ, বিত্ত নির্বিশেষে সকলে এই উৎসবে স্বতঃস্ফুর্তভাবে যোগদান করছে। উৎসবকে কেন্দ্র করে বহু মানুষের রুজি-রোজগারের বন্দোবস্ত হচ্ছে। বাঙালি তথা সনাতনপন্থী হিসেবে এ অত্যন্ত গর্বের বিষয়। কিন্তু পূজার মূল পরম্পরা কি কোথাও ক্ষুণ্ন হচ্ছে? থিমসজ্জায় মেতে বহু বাঙালি শিল্পীর অন্ন সংস্থান হচ্ছে বটে, কিন্তু শিল্পের নামে দেবীর বিকৃত মূর্তি কি যন্ত্রণার কারণ নয়? আগমনী গানের সেই ঘরের মেয়ে উমা কি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনের ভিড়ে! প্রশ্নগুলির উত্তর আমাদের অজানা। কিন্তু ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে প্রতি বছর। বর্তমান বঙ্গে টোল সংস্কৃতির পতন ঘটেছে। সরকারী অনুদান নেই, সাহায্য নেই। সাবেক রীতিতে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার সুযোগ কম। অন্যদিকে বাংলায় অন্য ভাষার ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সরকারি সাহায্যেই রমরমিয়ে চলছে। ফলশ্রুতিতে বাংলায় সংস্কৃতজ্ঞ শিক্ষিত পুরোহিত অমিল। যাঁরা মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষা শিক্ষা করছেন, তাঁরা পৌরহিত্য করছেন না। ফলত, অধিকাংশ মণ্ডপ বা পূজাতেই বহুল ক্রটিযুক্ত পূজা দেখে ও অশুদ্ধ উচ্চারণে মন্ত্র ও চণ্ডীপাঠ শুনে ভগবতীর চরণে প্রাণ সমর্পণ করতে সাধ যায়। এছাড়াও এখন পূজার উদ্বোধনের দিনক্ষণ মানা নেই, বিসর্জনের কোনও দিনক্ষণ নেই, সবই নিজেদের সুবিধামতো। বর্তমানে দুর্গাপূজার থেকেও উৎসবটাই অধিক প্রাধান্য পায়। দুর্গাপূজা আসলেই সামাজিক মাধ্যম নানা মিথ্যাচার আর ইতিহাসবিকৃতিতে ভরে ওঠে, এক শ্রেণীর মানুষ শুধু এটুকুতেই আনন্দ পায়। বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য আজ বিলাসবহুল বিনোদনের পায়ের নীচে লুটোয়। তবে, কোথাও কোথাও এখনও ঐতিহ্য, পরম্পরা মেনে পূজা হয়, এটিই ভরসা।
সহস্র বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, নিজস্বতা, পরম্পরা, বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট্য সকল কিছু নিয়েই বঙ্গস্রোতে শারদীয়া মহাপূজার নৌ ভেসে চলেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রতিবছর নতুন করে আমোদিত হয় এসব দেখে। আমরা বিশ্বাসী, স্বয়ং ভগবতী এর হাল ধরে আছেন। তাই আমাদের কর্তব্য শুধু বিস্মৃত ইতিহাসকে স্মৃতিতে ফিরিয়ে দেওয়া। বাকি তাঁর ইচ্ছে।
1 Comment
খুব সুন্দর লিখেছো প্রবালদা। জয় জয় জগজননী! 🙏🙏🙏