শ্রীরামকৃষ্ণ ও যুগাবতারত্ব

 শ্রীরামকৃষ্ণ ও যুগাবতারত্ব

“বিতরিতুমবতীর্ণং জ্ঞানভক্তিপ্রশান্তীঃ

প্রণয়গলিতচিত্তং জীবদুঃখাসহিষ্ণুম্।

ধৃতসহজসমাধিং চিন্ময়ং কোমলাঙ্গং

বিমলপরমহংসং রামকৃষ্ণং ভজামঃ।।”

ভারতীয় উপমহাদেশে উপস্থিত সকল বৈচিত্র্যের মধ্যে বিশিষ্টতা এই যে, এই পুণ্যভূমিতে উৎকীর্ণ আকর থেকে চিরকাল আধ্যাত্মিক সম্পদই অধিক খনিত হয়েছে। অকূল সফেন সমুদ্রে রত্নপুঞ্জের যে বৈচিত্র্য, ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক দর্শনের অপরিমেয়তা তাকে বিজিত করে। ভারতবর্ষে তাই যুগে যুগে বিচিত্র ভাবরাজি নিয়ে এক শ্রেণীর মানুষের আবির্ভাব ঘটে, যাঁরা যুগ-প্রয়োজনীয় ধর্মের সূত্রপাত করেন, আধ্যাত্মিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচার করেন। তাঁদের ভাব ভিন্ন হলেও ভারতীয় সনাতন ধর্মের মূল সূত্রের সঙ্গে নিবিড় বন্ধন থাকে। লোকসমাজে এঁরা ঈশ্বরমূর্তিতে কল্পিত হন, শাস্ত্রে এঁদের অবতার হিসেবে বন্দনা করা হয়। ভারতবর্ষের বুকে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস এমনই এক যুগপুরুষ, সম্ভবত, এই পর্যন্ত শেষ সফল ধর্মান্দোলনের হোতা। তাঁর ১৮৬তম আবির্ভাব বার্ষিকীর পুণ্যলগ্নে আমরা সেই পুণ্যজীবনের আলোচনার মাধ্যমে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করব এবং আমাদের আধ্যাত্মিক পরিপ্রশ্নের যথাযথ উত্তর অনুসন্ধান করার চেষ্টা করব।

শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের সামাজিক প্রেক্ষাপট

দর্শনহীন আচারসর্বস্ব ধর্মাচরণের মূল সমস্যা হল, বদ্ধ জলে পানার মতো তা কুসংস্কারে ভরে যায়। স্বার্থের অন্ধত্বে অগোচর হয় মনুষ্যত্ব। ঊনবিংশ শতকের সামাজিক প্রেক্ষাপট আমাদের সেই ধারণাই দেয়। ব্রিটিশ শাসনের ভিত দৃঢ়ভাবে চেপে বসেছে ভারতের বুকে। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবনে কর্তৃত্ব ফলাচ্ছেন একদল ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই অর্ধশিক্ষিত। তাঁরা ক্রমাগত বর্ণবিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছেন সমাজে। বেদ-উপনিষদ-গীতার দর্শনের প্রতিফলন নেই সমাজে, কেবল শরিয়তি আইনের মতো ফতোয়া রয়েছে। এক দল নিষ্পেষিত হচ্ছে, অন্যদল যাবতীয় সুবিধা ভোগ করছে। এই সময় সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত হয়েছে নারী-সমাজ। বাল্যবিবাহ, অকালবৈধব্য, অশিক্ষা, পর্দাপ্রথা প্রভৃতি নানান কুপ্রভাবে মেয়েদের অবস্থা তখন শোচনীয়। রক্ষণশীল মহল্লায় নারীর শিক্ষা তখন অমাবস্যায় চন্দ্রোদয়ের মতোই অসম্ভব ব্যাপার। সমস্যাগুলি পড়তে বা লিখতে সহজ মনে হলেও পৃথিবীর গভীরতম খাতের থেকেও তা গভীর ছিল। সাগর পেরিয়ে বিদেশযাত্রা করলে যে জাতি ধর্মচ্যুত হয়, সেই জাতির অগ্রগতি কিভাবে সম্ভব? রাজনৈতিক কারণেই ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী এ সকল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি। মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাঙালি যে সংস্কারের চেষ্টা করেননি তা নয়। কিন্তু বর্তমানেও যেটা হয়, মানুষ প্রচলিত কুসংস্কারগুলির বিরোধিতা করতে গিয়ে মূলানুগ ধর্মেরই বিরোধিতা করে, ধর্মের পতন কামনা করে, সেটাই সেযুগে হয়েছিল। কুসংস্কার ধর্ম থেকে উদ্ভূত হয়, এ’কথা সত্যি, কিন্তু বহুযুগবাহী ধর্মের গতি স্তব্ধ করার চেষ্টা করা হলে যে সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, তার নিবারণ সম্ভবপর নয়। পুষ্করিণীতে পাঁক, পানা হলে তা সংস্কার করতে হয়, পুকুরটাই বুজিয়ে দিলে সমস্যা কি বাড়ে বৈ কমে? তাই প্রয়োজন ছিল এমন এক যুগপুরুষের, যিনি ধর্মের মূলসূত্র অক্ষুণ্ন রেখে তার আচার-আচরণকে মূলানুগ করবেন। এই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা থেকেই আবির্ভাব ঘটেছিল শ্রীরামকৃষ্ণদেবের। ১৮৩৬-এর ১৮ই ফেব্রুয়ারী, ফাল্গুন শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে বাংলার হুগলি জেলার অখ্যাত কামারপুকুর গ্রামে ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় ও চন্দ্রমণি দেবীর ধর্মনিষ্ঠ ও রক্ষণশীল ঘরে জন্ম নেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর বাল্যাবস্থা থেকেই প্রচলিত কুপ্রথাগুলি ভাঙার চেষ্টা চোখে পড়ে আমাদের। উপনয়নের সময় রীতি ভেঙে তিনি ভিক্ষা নেন অব্রাহ্মণ ধনী কামারিনীর থেকে। পূজার্চনাদিতে গতে-বাঁধা আচারের বাইরে ভাবসম্মিলনের প্রাধান্যই প্রকট হয়ে ওঠে। এতে সমাজে গুঞ্জন তৈরি হলেও দেখা যাচ্ছে, সনাতন সংস্কৃতির পরিপন্থী তা কখনোই হচ্ছে না। শাস্ত্রে বাহ্যপূজাকে অধমাধম আখ্যা দিয়ে মানসপূজারই শ্রেষ্ঠত্ব কথিত হয়েছে। হিন্দুশাস্ত্রের অলিগলিতে জন্মভিত্তিক বর্ণবাদকে নস্যাৎ করে কর্ম ও সংস্কারভিত্তিক বর্ণের কথা বলা হয়েছে। তাহলে এতদিন তা পালিত হয়নি কেন? তাহলে যে একদল বর্ণশ্রেষ্ঠ সমাজের হোতা কর্মহীন হয়ে পড়বেন! বহিঃশত্রুর আক্রমণে জাতির শুদ্ধতা রক্ষার্থে ঐতিহাসিকভাবে যে বর্ণবাদের সৃষ্টি হয়েছিল, ক্রমে তা বিভেদের শিকড় ছড়িয়ে দিয়েছিল জাতির মধ্যেই। শ্রীরামকৃষ্ণ আঘাত করেছেন এর মূলে। দক্ষিণেশ্বরে রাণী রাসমণির জগদীশ্বরী মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণ যখন গেলেন, তখনও তিনি পুরোপুরি প্রচলিত সংস্কারের বাইরে বেরোতে পারেননি। গঙ্গার ধারে স্বপাক আহার করতেন। পরে সব একাকার হয়ে যায়। তিনি আসলে তফাতটা ধরিয়ে দিয়ে গেছেন নিজে আচরণ করে। 

বস্তুবাদ ও আত্মবিজ্ঞান

ভূমিকাতে আমরা বলেছিলাম, ভারতবর্ষে চিরকালই আধ্যাত্মিক জ্ঞানের চর্চা হয়ে আসছে। ভারতবর্ষ প্রাচীনকাল থেকেই এমন এক উপলব্ধির সন্ধানে ব্যাপৃত থেকেছে, যা ‘অবাঙ্‌মানসগোচর’। দিব্যশক্তির আধার মহাপুরুষেরা বারংবার ভারতে জন্ম নিয়েছেন। বৈদিক যুগের মুনি-ঋষিরাই ক্রমে পৌরাণিক যুগ থেকে অবতাররূপে বন্দিত হয়েছেন। সেখান থেকে তন্ত্রসাহিত্যে গুরুর ধারণা উপস্থিত হয়েছে। আধ্যাত্মিক সম্পদপুষ্ট ভারতবর্ষে জড়সম্পদও কিছু কম ছিল না। যার জন্য যুগে যুগে বহিঃশত্রুর আক্রমণ হয়েছে এবং তারা ভারতবর্ষের ঐহিক সম্পদ আহরণ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছে। যারা সাম্রাজ্যবিস্তার করে থেকে গেছে, তারা আপন ধর্ম চাপিয়ে দিতে চেয়েছে ভারতীয় জনজীবনে। এভাবেই ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক সম্পদ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এসেছে, সঙ্গে ঐহিক সম্পদও। এহেন দেশে ব্রিটিশ এসে সাম্রাজ্যের পত্তন করল। এই শাসকবর্গ সরাসরি ধর্মপ্রচার না করলেও বহিরাগত খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বীরা সহজেই তাদের ধর্মপ্রচার করতে শুরু করল। শুধু তাই নয়, চিরন্তনী ত্যাগের আদর্শ দূরে সরিয়ে রেখে মানুষকে ধীরে ধীরে পাশ্চাত্যের ভোগবাদ বা বস্তুবাদের দিকে আকৃষ্ট করতে থাকল। তার ফলে চারিত্রিক অবনমন, নাস্তিক্য, দর্শনহীন সভ্যতা তৈরি হতে সময় লাগল না। খ্রিস্টধর্মানুসারী একেশ্বরবাদ প্রচারিত হল, পৌত্তলিকতাবিরোধী মতবাদ তৈরী হল। বেদ-বেদান্তের অদ্বৈততত্ত্ব মানুষ জানল না। মূর্তিপূজায় যে ধাতু-পাষাণের পূজা হয় না, পূজা হয় এক ও অখণ্ড চৈতন্য সত্তার, তা মানুষ শিখল না। ইত্যাকার পরিস্থিতিতে শ্রীরামকৃষ্ণ এলেন। সাধনা ও সিদ্ধিলাভ করলেন। মানুষকে বললেন তাঁর ঈশ্বরদর্শনের কথা। আচারসর্বস্ব মানুষজন চমকে উঠলেন। সন্দেহ করলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ থেমে থাকলেন না। সুদীর্ঘকালের শোষণের ফলে আন্তরিক যে হীন অবস্থা হয়েছিল, তাতে বস্তুবাদকে অস্বীকার করার উপায় ছিল না। ঠিক সেই বিন্দু থেকেই রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের কার্যপ্রণালী আরম্ভ হয়েছিল। বস্তুবাদকে স্বীকার করেও নির্বিকার চিত্তে কীভাবে আত্মবিজ্ঞানের মনন সম্ভব, এবং তদ্দ্বারা কীভাবে ধর্মপ্রাণ ভারতবর্ষের চৈতন্য পুনর্জাগরুক করা যায়, তা-ই শ্রীরামকৃষ্ণ সহজভাবে শিখিয়েছেন। সমাজের ক্ষুদ্র একক থেকেই তিনি শিখিয়েছেন, তাই এক সংসারীকে উপদেশ দিচ্ছেন এভাবে, “সংসারে থাকবে পাঁকাল মাছের মতো, পাঁকাল মাছ পাঁকে থাকে, কিন্তু তার গায়ে পাঁক লাগে না!”

লোকশিক্ষা

শ্রীরামকৃষ্ণ জনমানসে ছড়িয়ে দিলেন বেদান্তের ভাবনা, কালীঘরে বসে! মনে পড়ে যায়, আচার্য শংকরের কথা। গোটা ভারতবর্ষে অদ্বৈততত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেও তিনি শৃঙ্গগিরিসহ চারটি মঠে শ্রীযন্ত্র, চন্দ্রমৌলীশ্বর পূজার সূচনা করে গিয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণও সনাতন ধর্মের সাকার ও নিরাকার দুটি উপাসনাই স্বীকার করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণচরিত্রের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর সহজিয়া ভাব ও ভাষা। শাস্ত্রের কঠিন ভাষা পণ্ডিতে বুঝতে পারে, কিন্তু তার মর্ম জনমানসে ছড়িয়ে দিতে গেলে সহজিয়া ভাব দরকার। শ্রীচৈতন্য শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, গোটা বিদ্বৎসমাজ তাঁর পাণ্ডিত্যে ও তার্কিকতায় থরহরিকম্পমান। কিন্তু তিনি যদি শুধু পণ্ডিত জিতে ক্ষান্ত হতেন, যদি দ্বারে দ্বারে গিয়ে কেঁদে কেঁদে নাম না বিলোতেন, তবে ভক্তিশাস্ত্রের প্রেমধন কি সাধারণ্যে পৌঁছাত? শ্রীরামকৃষ্ণ গ্রাম্যভাষায় সাধারণ মানুষকে যা দিয়ে গেছেন, অনেক খেতাবধারী পণ্ডিতও শাস্ত্র থেকে তা উদ্ধার করতে পারেননি। ব্যবহারিক জীবনের নানা উপদেশও তিনি সহজভাবে দিয়ে গেছেন, যাতে সুস্থ সমাজ গঠন হতে পারে। জন্ম-নিয়ন্ত্রণ ও আধ্যাত্মিক জীবনে উন্নতির জন্য স্বামী-স্ত্রীর কীরূপ আচরণ কর্তব্য তাও বলেছেন। মনে রাখতে হবে, অনিয়ন্ত্রিত জন্ম ও দারিদ্র্য আজও ভারতীয় উপমহাদেশের পরস্পর-সংযুক্ত একটি সমস্যা।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও সনাতন ধর্মভাবনা

শ্রীরামকৃষ্ণ সনাতন ধর্মের প্রচলিত বেশ কিছু শাখায় সাধনা করেছেন ও সিদ্ধিলাভ করেছেন। তাঁর সাধনজীবনের দুর্লভ বৈচিত্র্য আমাদের আকৃষ্ট করে। বাল্যকাল থেকে তিনি গৃহস্থ রঘুবীর শালগ্রাম, রামেশ্বর শিবের অর্চনা করেছেন, দ্বিজোচিত সান্ধ্যোপাসনা করেছেন। দক্ষিণেশ্বরে আসার কিছুকাল পর কেনারাম ভট্টাচার্যের কাছে তাঁর শাক্তদীক্ষা লাভ হয়। জগদীশ্বরী, শ্রীরামকৃষ্ণ যাঁকে আদর করে ভবতারিণী নাম দিলেন, তাঁর পূজায় নিযুক্ত হন। বাল্যকাল থেকেই সরলমতি শ্রীরামকৃষ্ণের বাৎসল্যোচিত প্রেমাদর মিশ্রিত মাতৃভাবের সাধনায় তিনি মা-কে লাভ করলেন। মায়ের দর্শনলাভের জন্য যে ব্যাকুলতা ও কঠোর সাধনবৃত্তির বর্ণনা আমরা পাই, তা পূর্বপূর্ব অবতারেও খুব সুলভ নয়। ‘মা’ বলে কেঁদে বালুকায় মুখ ঘষা, জঙ্গলে গিয়ে গভীর রাতে বর্ণশ্রেষ্ঠের অহংকার তথা শাস্ত্রবর্ণিত লজ্জা-ঘৃণাদি অষ্টপাশমুক্ত হয়ে ঐকান্তিক ঈশ্বরসাধনা, এ-সকলই সনাতন ধর্মভাবনার চরমতম সিদ্ধান্তের ইঙ্গিতবাহী। জগদম্বার প্রথম দর্শনেই তিনি ক্ষান্ত হননি, তিনি তাঁর কঠোর সাধনার মাধ্যমে পুনর্বার জগতের হিতের জন্য জগদম্বার দর্শনলাভ করেছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি শ্রীহনুমানের ভাব আশ্রয় করে দাস্যভক্তিতে শ্রীরাম-সীতার দর্শন পেয়েছেন। এরপর ভৈরবী ব্রাহ্মণী নাম্নী সাধিকার কাছ থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ তন্ত্রমার্গের সাধনা করেন, যিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম অবতাররূপে বর্ণনা করেন। তন্ত্রশাস্ত্রের গুহ্য থেকে গুহ্যতর, কঠিন থেকে কঠিনতর সাধনপরীক্ষায় তিনি সিদ্ধিলাভ করেন। তিনি রাধারাণীর ভাবে শ্রীকৃষ্ণের সাধনা করেছেন, জটাধারী সাধুর নিকট প্রাপ্ত বালক রামের বিগ্রহে বাৎসল্যভাবের সাধনা করেছেন। এমনভাবেই শান্ত-দাস্য-সখ্য-মধুর-বাৎসল্য এই পঞ্চভাবের বৈষ্ণবসাধনপ্রণালীকে আত্মস্থ করে অদ্বৈতসিদ্ধান্তে উপনীত হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সর্বশেষ, শ্রীতোতাপুরী নামা দশনামী সন্ন্যাসীর কাছে সন্ন্যাসগ্রহণ করে শঙ্করীয় অদ্বৈতসাধনার মাধ্যমে নির্বিকল্প সমাধিরাজ্যে প্রতিষ্ঠা পান। ঈশ্বরদর্শন ও অদ্বৈতভাব লাভ করাই সব সাধনার উদ্দেশ্য, উপনিষদাদি গ্রন্থের এই সিদ্ধান্তই শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি কখনও কাঙালিদের উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করেছেন, কখনও বিষ্ঠায় চন্দনের ভাব দেখেছেন, এমনই ছিল তাঁর অদ্বৈতবিশ্বাস। এই অদ্বৈতবিশ্বাস থেকেই ভিন্নধর্মের সাধনপদ্ধতিও তিনি আচরণ করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সন্ন্যাসগ্রহণের মাধ্যমে বৈদিক আশ্রমপ্রথাকেও স্বীকার করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতে বিশেষ দক্ষ ছিলেন। কথামৃতসহ অন্যান্য গ্রন্থ থেকে তাঁর সঙ্গীতপ্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। বাল্যকালে যাত্রা প্রভৃতিতে অভিনয় করেছেন, কখনও শিবের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে চরিত্রের ভেতর নিবিষ্ট হয়ে বাহ্যজ্ঞান হারিয়েছেন। আবার মূর্তি তৈরি বা চিত্রকলাতেও তিনি পারদর্শী ছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে প্রথম জীবনে দক্ষতার সঙ্গে বিগ্রহে বেশশৃঙ্গারাদি করেছেন। সুতরাং শিল্পভাবনার মাধ্যমেও যে ঈশ্বরোপলব্ধি হতে পারে, শ্রীরামকৃষ্ণই তার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। রাগাদিসেবার কথা ধর্মশাস্ত্রেও পাওয়া যায় এবং ভারতীয় শৈল্পিক দর্শনে আত্মবিজ্ঞানেরই আভাস পাওয়া যায়।  

নারীসমাজ

ঊনবিংশ শতকের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্থান আগেই বর্ণনা করা হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণের কিছু কিছু উপদেশে তাঁকে পুরুষতান্ত্রিক বলে মনে হলেও যুগপ্রেক্ষিতে তিনি পুরুষজাতির নারীলালসাকেই তিরস্কার করেছেন। ব্যক্তিবিশেষে তিনি কাউকে নারীসঙ্গ করতে মানা করলেও, সেটি সেই ব্যক্তি বা সেই নারীর জন্যই যুক্ত, এটি মানতে হবে। নারীসঙ্গকেই যদি তিনি অন্যায় হিসেবে ধরতেন, তবে মা চন্দ্রমণি দেবী, ও শ্রীশ্রীমা অর্থাৎ সারদামণি দেবীকে দক্ষিণেশ্বরে রেখে দিতেন না। জ্বরপীড়িত শ্রীশ্রীমায়ের আরোগ্য কামনায় ব্যাকুল হতেন না। শ্রীশ্রীমা-কে ভ্রমবশত ‘তুই’ ডেকে ফেলেছেন বলে সারারাত্রি অনিদ্রায় থেকে ভোরবেলা ক্ষমা চাইতে যেতেন না। বিবাহিত বহু ভক্তদের সঙ্গ করতেন না। কামারহাটির গোপালের মা-র কাছে বায়না করে নাড়ু খেতেন না। গৌরীমা-কে সন্ন্যাস দিতেন না। ভৈরবী ব্রাহ্মণীকে গুরুপদে বরণ করতেন না। এমন অনেক কিছুই করতেন না। শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে অদ্ভুতভাবে। ফলহারিণী অমাবস্যার রাতে স্বীয় পত্নী শ্রীসারদামণি দেবীকে তিনি ষোড়শীরূপে পূজা করেন। পূজাশেষে নিজের জপমালা ও সাধনার ফল সমর্পণ করেন শ্রীশ্রীমা-র চরণে। এটি যে শুধু নারীর সম্মানের প্রেক্ষিতেই গুরুত্বপূর্ণ তা নয়। সনাতন ধর্মে যে ছয়টি আম্নায় আছে, তার সর্বশেষ আম্নায়টি হল অনুত্তর আম্নায়। মন্ত্রসাধনার চরমতম অবস্থা এখানে। এই অনুত্তর আম্নায়ের অধিশ্বরী হলেন ভগবতী মহাষোড়শী, যাঁর পরে আর উত্তর নেই, তাই অনুত্তর! শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনজীবনের পরিসমাপ্তিতে ষোড়শীপূজা তাই গভীরতম ধর্মভাবনারই ফসল।  শ্রীরামকৃষ্ণ শিখিয়েছেন নারীর সম্মান। তাঁর প্রোথিত বীজ অঙ্কুরিত ও পল্লবিত হয়ে ক্রমে ভারতবর্ষে নারীসমাজে এক ব্যাপক আন্দোলনের সূচনা করেছে। নারী শিক্ষা পেয়েছে, স্বাধীনতা পেয়েছে, শান্তি পেয়েছে, আধ্যাত্মিক সাধনার শরিক হতে পেরেছে বহুযুগ পর। শ্রীশ্রীমা, স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা, গৌরী মা প্রমুখের প্রচেষ্টায় এই আন্দোলন সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। আজ ভগিনী নিবেদিতার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে যেমন মেয়েরা শিক্ষালাভ করে, তেমনই গৌরীমায়ের প্রতিষ্ঠিত মঠে, শ্রীসারদা মঠ ও মিশনে সন্ন্যাসিনীরা আধ্যাত্মিক সাধনায় ও জীবসেবায় ব্যাপ্ত থাকেন। কলকাতায় প্লেগ মহামারীর সময়ে ভগিনী নিবেদিতার অবদান বঙ্গবাসী কখনও বিস্মৃত হবে না।  শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পরেও কথিত আছে, তিনিই সূক্ষ্মশরীরে এসে শ্রীশ্রীমা-কে বৈধব্যের চিহ্ন গ্রহণে নিষেধ করেন। বৈধব্যের যন্ত্রণা, উপরন্তু নানাবিধ সামাজিক রক্ষণশীলতা ও লাঞ্ছনার হাত থেকে কি এভাবেই রক্ষা করে গেলেন না? শ্রীশ্রীমায়ের প্রতি শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ ছিল, “কামারপুকুরে গিয়ে থাকবে, শাক বুনবে, শাকভাত খাবে আর হরিনাম করবে।” মেয়েদের স্বনির্ভর করাটাও কিন্তু এই ভাবান্দোলনের একটি অংশ, শ্রীরামকৃষ্ণ যার সূত্রধর। 

শ্রীরামকৃষ্ণ ও বেদান্তের দৃষ্টিভঙ্গি

শাক্ত, বৈষ্ণব সমস্ত মতে সাধন করলেও শ্রীরামকৃষ্ণ আগাগোড়াই বেদান্ততত্ত্বে নিষ্ণাত ছিলেন। পূর্বেও আলোচিত হয়েছে, শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্বৈত প্রতিষ্ঠা ও সমাধিরাজ্যে তাঁর গতায়াত কত দৃঢ় ছিল। তাঁর জীবনীগ্রন্থ অনুসন্ধান করলেই প্রমাণিত হয়, সত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ ও যুক্তিবাদিতায় তাঁর দৃঢ়তা। সর্বভূতে তিনি ভূমানন্দের অনুভব করেছিলেন, যার জন্য নিপীড়িত মানুষের জন্য মন ব্যাকুল হয়েছে। বলছেন, “কলকাতার লোকগুলো সব অন্ধকারে কিলবিল করছে!” পর্যটনে গিয়ে তিনি আর্তের জন্য কেঁদেছেন। বৈষ্ণবের ‘জীবে দয়া’ শুনে তিনি বলেছেন ‘জীবসেবা’-র কথা। বিগ্রহে যে সত্তার উপলব্ধি ঘটে, জীবের আবরণে সেই চৈতন্যসত্তাই ক্রিয়াশীল। এই ভাবনাই চিরাচরিত বেদান্তের দর্শনে নতুন মাত্রা সংযোজিত করেছে। নিরুক্তকার লিখেছিলেন, “একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি!” শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, “যত মত তত পথ!” শ্রীমদ্ভাগবতের রাসলীলায় শ্রীভগবান গোপীদের সঙ্গে রাসকেলি করার মানসে বললেন, “একং বহুষ্যামি।” অর্থাৎ, যত গোপী, তত কৃষ্ণ। গোপীগণও আবার শ্রীকৃষ্ণেরই আনন্দরূপের হ্লাদিনীশক্তি। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন এই একত্বের প্রচারণা মাত্রই। বেদান্তমাত্রেই তা অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য, তাই শ্রীরামকৃষ্ণের বেদান্তের লঙ্ঘন করে না। অদ্বৈতে প্রতিষ্ঠিত হয়েও তিনি দ্বৈতবাদকে অস্বীকার করেননি। ব্রহ্মাণ্ডের এমন কোনও প্রশ্ন নেই, যার উত্তর বেদান্তে নেই, শ্রীরামকৃষ্ণ তার সূত্র ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের ইতিহাসে রেখে গেছেন। সারাবিশ্বের মানুষের কাছে আদৃত হয়েছে তাঁর বাণী। 

উপসংহার

সনাতন ধর্মের মূলকে অক্ষুণ্ন রেখে তার উপরে জমা পঙ্কিলতা সরিয়ে সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় ধর্মের প্রভাবকে যুগোপযোগী করে তোলা প্রয়োজন ছিল। তাই প্রয়োজন ছিল এক যুগাবতারের। কামারপুকুরের এক পূজারি ব্রাহ্মণ গেঁয়ো ভাষায় সেই সংস্কারের আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিলেন, যা আজও ক্রিয়াশীল। মাত্র পঞ্চাশ বছরের জীবনে কঠোর সাধনার মাধ্যমে, শিক্ষার মাধ্যমে, আচরণের মাধ্যমে তিনি দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, অবতারের সংজ্ঞা কী! আমরা মূর্খ, হয় তাঁকে পূজা করি, তাঁর বাণীর অনুগমন করি না, নতুবা তাঁর সমালোচনা করি এখনকার সময়ের প্রেক্ষিতে, কিন্তু তাঁর দর্শনের সঙ্গে প্রেক্ষাপট ও সনাতন ধর্মের ভাবনাকে মিলিয়ে দেখি না। হালফিলের এক স্বয়ম্ভূ তথাকথিত বৈষ্ণব গুরু শ্রীরামকৃষ্ণকে ‘A crazy priest’ বলে উল্লেখ করেছেন, কারণ? কারণ, শ্রীরামকৃষ্ণ কৃষ্ণের পূজা না করে কালীর পূজা করেছেন! তাঁরা আবার দেশে-বিদেশে হরিনাম প্রচার করে বেড়াচ্ছেন! ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মের কোন সিদ্ধান্তটি প্রচার হচ্ছে তবে? স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ঠাকুরের অনন্ত ভাব, কে বোঝে! শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ পার্ষদ হয়েও যদি তিনি না বোঝেন, আমরা কীভাবে তাঁকে বুঝব? আমরা যেটুকু আলোচনা করছি, তা তাঁর সত্তার কোটিভাগের এক অংশও নয়। শুধু এটুকু বুঝি, তিনি না এলে সনাতন ধর্ম ও তৎসম্পৃক্ত সমাজ আজ অন্যরকম পর্যায়ে পৌঁছে যেত। অজ্ঞানের আঁধারে বাংলার ভাগ্যাকাশে তিনি বেদান্তসূর্যরূপে উদিত হয়েছেন। তাঁকে যুগাবতার, যুগপুরুষ জ্ঞান করতে পারার মতো সংস্কার বোধকরি আমাদের সকলের নেই। ব্রহ্মোপাসক কবিগুরু লিখেছেন, 

“বহু সাধকের
বহু সাধনার ধারা,
ধেয়ানে তোমার
মিলিত হয়েছে তারা;
তোমার জীবনে
অসীমের লীলাপথে
নূতন তীর্থ
রূপ নিল এ জগতে;
দেশ বিদেশের
প্রণাম আনিল টানি
সেথায় আমার
প্রণতি দিলাম আনি।।”

Subhadeep Saha and Probal Roy Chowdhury

Subhadeep Saha is a Kolkata based freelance writer and commentator. He is an associate of The Saborno Sangrahalay – an evolving India studies resource centre in Kolkata. Dr Probal Roy Chowdhury is an independent researcher and educational consultant. He currently engages in scholarly explorations on the history of indigenous education in modern India and on cultural and ritual traditions of Bengal, especially the Durga Puja festival. He is the founder-secretary of The Saborno Sangrahalay – an evolving India studies resource centre in Kolkata

0 Reviews

Related post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *