মহাশিবরাত্রি
স্কন্দ পুরাণ এবং স্মৃতিতে, মাঘের শেষ বা ফাল্গুনী প্রথম কৃষ্ণপক্ষীয় চতুর্দশী তিথিকে মহাশিবরাত্রি নামে অভিহিত করা হয়েছে। তন্ত্রে শিব বলছেন, পুষ্প-ধূপ-দীপ আদি নৈবেদ্যে তিনি যত না সন্তুষ্ট হ’ন— তার থেকে অধিক সন্তুষ্ট হ’ন শিবরাত্রির উপবাসে।
উপবাস অর্থে তাঁর সমীপে বাস। শিবমহিমা চিন্তনে একটি রাত্রি যাপন করাই বৃহৎ অর্থে উপবাস। আচার-অনুষ্ঠান কেবলই বাহ্যিক অঙ্গ মাত্র। বাহ্যিক উপবাসের ক্ষেত্রে বলি, নির্জলা উপবাসে যিনি অক্ষম, শাস্ত্রের বিধান অনুসারে তিনি উপবাসদিনে পাঁচটি দ্রব্য গ্রহণ করতে পারেন— ১) জল, ২) ফল, ৩) দুধ, ৪) ওষুধ, ৫) তাম্বুল বা পান।
শিবোপাসকদের কাছে প্রতিটি চতুর্দশীই শিবরাত্রি। সাধকগণ তাঁদের সাধনার স্রোতকে অব্যাহত রাখতে প্রতি পক্ষের চতুর্দশীতেই শিবের উপাসনা করেন। কেবলমাত্র এই তিথি মহাশিবরাত্রি নামে খ্যাত। এইদিন রাত্রির প্রথম প্রহর থেকে পূজা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গ বা বাণলিঙ্গ অথবা পার্থিব অর্থাৎ মাটির শিবলিঙ্গ গড়েও পূজা করা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বঙ্গদেশে শিবরাত্রিতে এই মৃন্ময় শিবলিঙ্গ পূজারই প্রচলন অধিক ছিল। বর্তমানের আধুনিক জীবনে এই প্রচলন লুপ্তপ্রায়।
মাটির শিবলিঙ্গে পূজা করতে হলে, চতুঃপ্রহরব্যাপী পূজার প্রত্যেক প্রহরে একটি করে শিবলিঙ্গ গঠন করতে হ’য়— নির্দিষ্ট পরিমাণ মাটি দিয়ে। প্রাহরিক পূজান্তে সেই শিবলিঙ্গ মন্ত্রপূত বিসর্জন করে নতুন লিঙ্গ নির্মিত হ’য়। সাধকের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের এক পর্বের সমান শিবলিঙ্গে পূজা প্রশস্ত।
‘শিবরহস্য’ অনুযায়ী, পূজার প্রারম্ভিক কর্মাদি সমাপন করে গণপতি ইত্যাদি বিভিন্ন দেবতার পূজা কর্তব্য। এরপর মাটি দিয়ে শিবলিঙ্গ গড়ে তাতে শিবের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হ’য়। নিজ হৃদয়ে জাজ্বল্যমান অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ শিবময় বিগ্রহে মানসোপচারে আরাধনা করার পরে কল্পনায় সাধক উক্ত লিঙ্গাকৃতি বিগ্রহে প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে নানাবিধ বাহ্যিক উপহারে তাঁকে অর্চনা করে স্নান করানো হ’য়। প্রথম প্রহরে ঈশান রূপে দুধ, দ্বিতীয় প্রহরে অঘোর রূপে দধি, তৃতীয় প্রহরে বামদেব রূপে ঘি এবং চতুর্থ প্রহরে সদ্যোজাত রূপে মধু দিয়ে স্নান করানো হ’য়। এর-সাথেই প্রত্যেক প্রহরে পশুপতি রূপে জল দিয়ে স্নান করাতে হ’য় এবং প্রত্যেক প্রহরে স্নানের পর একটি করে বিল্বপত্র ইত্যাদির অর্ঘ্য নিবেদিত হ’য় শিবের চরণে। অতঃপর শিবাঙ্গলগ্না গৌরী, শিবের অষ্টমূর্তি, নন্দী-ভৃঙ্গীসহ অনুচরগণ— এঁদের পূজা করা হ’য়। এইভাবে চার প্রহরে পূজা শেষ হ’লে, সাধক রাত্রির বাকি অংশ জাগরণ করেন। পরপ্রভাতে স্নান ও নিত্যকৃত্য সমাপ্ত করে কোনও উপবাসী ক্ষুধার্তকে বা ব্রাহ্মণকে অন্নদান করে— সাধক নিজে অন্নজল গ্রহণ করেন। এছাড়াও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে শিবরাত্রির অর্চনা প্রসিদ্ধ। বৈদিক রুদ্রীপাঠ করে রুদ্রাভিষেক বহু মন্দিরেই প্রচলিত। নৃত্যগীতাদি বিভিন্ন কলা প্রদর্শনও শিবরাত্রি পূজার অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হ’য়।
শিবরহস্যের শিবরাত্রির ব্রতকথা পড়লে আমরা দেখতে পাই, এক ব্যাধের কথা। সারাদিন শিকার করার পর রাতের বেলা, ক্ষুধার্ত ব্যাধ আশ্রয় নেয় বেলগাছের ডালে। শিবরাত্রির দিন ছিল সেটা। গাছের নীচে ছিল শিবলিঙ্গ। শ্বাপদের ভয়ে গাছের ডালে নড়েচড়ে বসতেই ডাল থেকে একটি সজল পাতা ভেঙে পড়ে শিবলিঙ্গে। পরের দিন সকালে বাড়ি ফিরে স্নান সেরে যখন সে খেতে বসে, এক ক্ষুধার্ত অতিথি এসে পড়ায় তখনই সে তার অন্ন সেই অতিথিকে দান ক’রে। এভাবেই সম্পন্ন হয় তার শিবরাত্রি ব্রত। ব্যাধের মৃত্যুর পর সে শিবলোকগমনের অধিকারী হয়। এই ব্রতকথায় ব্রাহ্মণ্যবাদের কলুষ নেই। নিতান্তই একটি লৌকিক উপাখ্যান। আমরা যুগপ্রয়োজনে, জীবিকার তাগিদে যে অহোরাত্র মিথ্যাচার, পশ্বাচার করে চলি— তা-ই প্রতিফলিত ব্যাধের রূপকে। কিন্তু জীবনের কিছু সুন্দর কাজেই এই মানবজীবনের সার্থকতা।
ইদানীংকালে বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কে শিবলিঙ্গ নিয়ে অনেক বক্রোক্তি লক্ষ করি। প্রসঙ্গত জানাই, শিবলিঙ্গে পূজা করা হচ্ছে মানে কোনো লিঙ্গের পূজা করা হচ্ছে না। শিবলিঙ্গে শিবকে কল্পনা করে পূজা করা হচ্ছে। রজতগিরিনিভ সুন্দর এক পুরুষ শিব— যাঁকে মানসপটে ধ্যান করে সাধক ঐ লিঙ্গাকৃতি বিগ্রহে প্রতিষ্ঠা করছেন স্বকীয় কল্পনাতে। মহাশিবরাত্রি শিব-গৌরীর বিবাহের দিন। শিবলিঙ্গ এখানে শুধু লিঙ্গ নয়, তার সংলগ্ন হয়ে আছে মাতৃযোনি। সঙ্গমরূপ। নিখিল জগত তথা প্রতিটি মানুষের সৃষ্টি হচ্ছে যে প্রক্রিয়াতে— সেই প্রতীকেই পূজা হচ্ছে মহাশক্তির। শিবশক্তির মিলিত রূপ এটি। নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মিলনেই তো চলছে গোটা জগত। যৌনতা যেখানে প্রতিটি মানুষের জীবনে অত্যন্ত স্বাভাবিক, সেখানে বক্রোক্তি কীসের? আদিম উপাসনার এই বিধি ইতিহাসে খুব নবীন নয়, বিজ্ঞজন একটু সন্ধানেই অবগত হবেন।
সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারী-সাধক থেকে বাড়ির মেয়ে-বৌ শিবরাত্রির ব্রত পালন সকলেই করেন। শিবের বৈরাগ্য কারও আদর্শ, আবার শিবের গৌরীপ্রেম কারও আদর্শ। বৈদিক রুদ্র থেকে হিমালয়ের পশুপতি হয়ে বাড়ির নেশাখোর শিব হতে সময় বিশেষ লাগে নি। তিনি ‘রুদ্রম্ চমকম্’-এও আছেন আবার ‘গাঞ্জা খাইয়া মগ্ন হইয়া নাচে ভোলানাথ’-এও আছেন। যে তাঁকে যেমনভাবে নিয়েছে— তিনি সেভাবেই রয়ে গেছেন আমাদের মননে।
শিব শব্দের অর্থ, মঙ্গলময়। মহাশিবরাত্রির রাত তাই এক মঙ্গলময় রাত। বিধিবদ্ধ শিবপূজা না করলেও, অন্ততঃপক্ষে জগতের মঙ্গলকামনায় আজকের রাতটি অতিবাহিত হোক, এই আবেদন রইল।