ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ৯

 ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ৯

ক্বণৎকাঞ্চীদামা করিকলভকুম্ভস্তননতা

পরিক্ষীণা মধ্যে পরিণতশরচ্চন্দ্রবদনা।

ধনুর্বাণান্পাশং সৃণিমপি দধানা করতলৈঃ

পুরস্তাদাস্তাং নঃ পুরমথিতুরাহোপুরুষিকা।।

আনন্দলহরী, শ্রীশঙ্করাচার্য

দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের তত্ত্বাবধানে দৈত্যকুলসহ ভণ্ড ষাট হাজার বছর ধরে শিবের অর্চনা ও বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের মাধ্যমে ক্রমশ নিজেদের সমৃদ্ধতর করে তুলতে লাগল। আচারনিষ্ঠার গুণে ও যজ্ঞপ্রভাবে তারা আরও বলশালী হয়ে উঠল। অন্যদিকে দেবরাজ ইন্দ্র যেন দৈত্যদের তুলনায় ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকলেন।

        সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার করে এবং দৈত্যদের এই সমৃদ্ধি ও আচারনিষ্ঠা দেবতদের জন্য অকল্যাণকর হয়ে উঠতে পারে, এই সম্ভাবনা তৈরি হতেই ভগবান বিষ্ণু নতুন পরিকল্পনা রচনা করলেন। বৈষ্ণবী মায়ার সাহায্যে সৃষ্টি করলেন এক অনন্যসুন্দরী নারী, ‘লোকবিমোহিনী’। ভগবান বললেন, “হে মৃগেক্ষণা, তুমি তোমার রূপে সমগ্র জগতকে বিমোহিত করতে পারো, তুমি তোমার ইচ্ছানুসার বিচরণ করলেও কেউ তোমার স্বরূপ জানতে সক্ষম হবে না। এখন যাও, দৈত্যকুলপতি ভণ্ডকে বিমোহিত করো। তোমার প্রেমের দ্বারা তাকে এই জগতসংসার থেকে বিস্মৃত করো।” এই আজ্ঞা শুনে বিমোহিনী বিশ্বাচীসহ স্বর্গের শ্রেষ্ঠ অপ্সরাদের সঙ্গে দৈত্যপুরাভিমুখে রওনা হলেন।

        ভণ্ডের রাজ্যে এসে বিমোহিনী একটি সুন্দর উদ্যান নির্বাচন করলেন। সেই উদ্যানের একপাশে স্ফটিকস্বচ্ছ সরোবরের তীরে বসে তিনি মধুবিনিন্দিত কণ্ঠে সংগীতের আলাপ শুরু করলেন। অন্যান্য অপ্সরারাও বীণা-আদি যন্ত্রে তাঁকে সঙ্গত করতে লাগলেন। এহেন সুধাময়ী ধ্বনি শুনে ভণ্ড ও অন্যান্য অসুরগণ উন্মত্তের মতো ছুটে ছুটে আসতে লাগলেন সংগীতের উৎস সন্ধান করতে। যথারীতি ভণ্ড ও অসুরগণ পৌঁছলেন সেই উদ্যানে এবং বিমোহিনীর রূপ, চারুতা ও কমনীয়তায় বিমোহিত হয়ে প্রেম নিবেদন করে বসলেন। বিমোহিনীর প্রাথমিক উদ্দেশ্য সফল হল।

        বিমোহিনী ও অন্যান্য অপ্সরার রূপ ও গুণের মোহে মত্ত হয়ে ভণ্ডাসুর-সহ সকল অসুরগণ ধর্মকর্ম সব বিস্মৃত হলেন। নারীসঙ্গেই দিন, পক্ষ, মাস কাটতে কাটতে একাদিক্রমে একশত আটটি বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। পুরোহিতগণ যজ্ঞাদির কথা মনে করাতে গেলে তিরষ্কৃত হয়ে ফিরে এলেন। দেবরাজ ইন্দ্রও এই কটি বছর পরম সুখে, নিশ্চিন্তমনে স্বর্গে রাজত্ব করলেন।

        একদিন দেবর্ষি নারদের আগমন হল স্বর্গরাজ্যে। দেবরাজ ইন্দ্রের দ্বারা সম্মানিত ও অভিবাদিত হয়ে তিনি বললেন, “হে দেবরাজ ইন্দ্র, আপনি হয়তো অবগত নন যে ভণ্ডের সঙ্গে যা ঘটছে, সকলই বৈষ্ণবী মায়া প্রভাব। অসীম শক্তিশালী দৈত্যপতি ভণ্ডকে দুর্বল করার জন্যই ভগবান বিষ্ণু এই মায়া বিস্তার করেছেন। এখনই উত্তম সময়, আপনি যুদ্ধে ভণ্ডকে পরাস্ত করতে পারেন। শত্রু যখন দুর্বল, তখনই উত্তম সময় তাকে সমূলে নাশ করার। কিন্তু যে-সকল দিব্য-অস্ত্রসমূহের সাহায্যে আপনি যুদ্ধ করবেন, তা আপনি পরাদেবীর তপস্যার মাধ্যমে প্রাপ্ত হবেন। তাই কালক্ষেপ না করে এখনই সকল দেবতাগণের সঙ্গে পরাদেবীর তপস্যার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন দেবরাজ।” দেবর্ষি নারদের উপদেশে ইন্দ্রসহ দেবগণ হিমালয়ের তটে ভাগীরথীর তীরে এক মনোরম স্থানে দেবীর মহাপূজা করলেন ও তপশ্চর্যায় দিন অতিবাহিত করতে লাগলেন। অন্যদিকে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য দৈত্যপুরীতে গমন করলে সেখানে আপন শিষ্যদের বিমোহিত অবস্থায় দেখতে পেলেন। তখন তিনি ভণ্ডকে বললেন, “ভগবান হরির মায়ায় তোমার মস্ত জাতি বিনষ্ট হতে বসেছে। তুমি মোহে আসক্ত হয়ে আছো, অন্যদিকে ছিদ্রান্বেষী ইন্দ্র তোমাকে পরাস্ত করার জন্য দেবগণসহ ভগবতী অম্বিকার তপস্যায় নিমগ্ন হয়েছে। যদি ভগবতী সন্তুষ্ট হন, তবে তোমার পরাজয় নিশ্চিত। অতএব এখনই যাও, দেবতাদের তপস্যায় বিঘ্ন উৎপন্ন করো, ওদের তপস্যা ভঙ্গ করো।” গুরুর আজ্ঞায় দৈত্যগণ হিমালয়ের তটে ছুটে যেতে লাগল।

Subhadeep Saha

Subhadeep Saha is a Kolkata based freelance writer and commentator. He is an associate of The Saborno Sangrahalay - an evolving India studies resource centre in Kolkata.

0 Reviews

Related post