ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ৮

 ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ৮

সুধাসিন্ধোর্মধ্যে সুরবিটপিবাটীপরিবৃতে

মণিদ্বীপে নীপোপবনবতি চিন্তামণিগৃহে ।

শিবাকারে মঞ্চে পরমশিবপর্যঙ্কনিলয়াং

ভজন্তি ত্বাং ধন্যাঃ কতিচন চিদানন্দলহরীম্ ||

আনন্দলহরী, শ্রীশঙ্করাচার্য

তিলোত্তমার সৌন্দর্যে পাগল হয়ে শুণ্ড ও উপশুণ্ড বন্ধুত্ব ও বরের কথা বিস্মৃত হল। তিলোত্তমাকে কে বিবাহ করবে সেই নিয়ে দুজনের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ লেগে গেল ও দুজনেই দুজনের হাতে মারা গেল। স্বর্গরাজ্যে আবার শান্তি ফিরে এল। তিলোত্তমা অপ্সরাবর্গে সম্মানের সঙ্গে স্থান পেলেন।

        ব্রহ্মা মন্মথের আচরণে অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে অভিশাপ দিলেন, “ক্ষমতার বশে অন্ধ হয়ে তুমি কি ঔচিত্যবোধ বিস্মৃত হয়েছ? যে শিব আমাকে ঘোরতর পাপের হাত থেকে আজ রক্ষা করেছেন, সেই শিবের তৃতীয় নয়নের অগ্নিতেই তুমি একদিন ভস্মীভূত হবে!” মন্মথ এবং রতি এই অভিশাপ শ্রবণে কাতর হয়ে ব্রহ্মার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করলে ব্রহ্মা বললেন, “মাতা ললিতা দেবী অবতরিত হয়ে তোমাকে পুনরায় উদ্ধার করবেন।” বসন্তবর্ণিত এই কাহিনি শুনে কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হয়ে রতিদেবী ভগবতী ললিতার নিকটে প্রার্থনা জানালেন।

অপরদিকে, শিবধামে চিত্রকর্ম নামের এক প্রমথ মদনের ভস্মসকল একত্র করে একটি পুত্তলিকা গড়ে শিবের নিকটে নিয়ে যেতেই সেই পুত্তলিকায় প্রাণের সঞ্চার হল এবং একটি পুত্রসন্তানের আবির্ভাব হল। চিত্রকর্ম তাকে শিবমন্ত্রে দীক্ষিত করলেন ও শিবের তপস্যার বিধান দিলেন। তপস্যা শেষে শিব আবির্ভূত হলে সেই বালক শিবের কাছে এক বিশেষ বর প্রার্থনা করলেন, “যে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসবে, তার শক্তির অর্ধেক আমার হয়ে যাবে। শত্রুর কোনও অস্ত্রই আমাকে বাঁধতে পারবে না।” শিব প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন এবং এও বর দিলেন, সে ষাট হাজার বছর রাজত্ব করতে পারবে।

        শিবের বরে বলীয়ান হয়ে সে তার সমস্ত তপস্যা, মূল্যবোধ বিস্মৃত হল। ব্রহ্মা তাকে ‘ভণ্ড’ নামে অভিহিত করলেন। ভণ্ড অসুররাজ্যে প্রবেশ করল। অন্যদিকে মন্মথের ভস্ম থেকে বিশুক্র, বিশুঙ্গ আরও হাজার হাজার দৈত্যের উৎপত্তি হল। ভণ্ডাসুর অসুররাজ্যে তাদের রাজা হয়ে তিনশো অক্ষৌহিনীর সেনাবাহিনী গঠন করল।

        দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য এসে তাদের দীক্ষাদান করলেন। নিত্য অনুষ্ঠান, যাগ, বৈদিক পরম্পরা অনুসরণ করে তারা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠল। অসুরদের স্থপতি ময় এসে মহেন্দ্র পর্বতে এক মনোরম মায়াময় নগরী নির্মাণ করল। সেই নগরী ‘শূন্যকাপত্তন’ নামে অবিহিত হল। বিশুক্র ও বিশুণ্ড সেই রাজ্যের যুবরাজ পদে অভিষিক্ত হল। শুক্রাচার্য ভণ্ডকে রাজ্যাভিষিক্ত করলেন। রত্নমুকুট, ছত্র, চামর ও নানাবিধ আভরণে ভূষিত হয়ে ভণ্ডাসুর সিংহাসনে আরোহণ করল। শিবের কোপাগ্নি থেকে জন্ম বলে সে অত্যন্ত তেজস্বী ছিল। ইন্দ্রশত্রু, অমিত্রঘ্ন, বিদ্যুন্মালী, বিভীষণ, উগ্রকর্মা, উগ্রধন্বা, বিজয়, শ্রুতিপারগ প্রভৃতি আটজন অতিবলশালী প্রধান দৈত্য রাজ্যের সুরক্ষাকার্যে নিযুক্ত হল। সুমোহিনী, কুমুদিনী, চিত্রাঙ্গী ও সুন্দরী নাম্নী চারজন রূপবতী নারীর সঙ্গে ভণ্ডাসুরের বিবাহ সম্পন্ন হল।

        সমস্ত দৈত্য শুক্রাচার্যের আদেশে দৈত্যগণ যাগযজ্ঞ ও শিবারাধনায় নিযুক্ত ছিল। দৈত্যগণ বেদপারঙ্গম ছিল, ও সমৃদ্ধশালী নগরীর গৃহে গৃহে যজ্ঞানুষ্ঠান করে সুখে বসবাস করতে লাগল। যাগযজ্ঞের ফলে তাদের শক্তিও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কিন্তু তারা মনে মনে দেবতাদের শত্রু মনে করে স্বর্গরাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনাও করছিল।

Subhadeep Saha

Subhadeep Saha is a Kolkata based freelance writer and commentator. He is an associate of The Saborno Sangrahalay - an evolving India studies resource centre in Kolkata.

0 Reviews

Related post