ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ৭

 ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ৭

ধনুঃ পৌষ্পং মৌর্বী মধুকরময়ী পঞ্চ বিশিখাঃ

বসন্তঃ সামন্তো মলয়মরুদায়োধনরথঃ ।

তথাপ্যেকঃ সর্বং হিমগিরিসুতে কামপি কৃপাম্

অপাঙ্গাত্তে লব্ধা জগদিদ-মনঙ্গো বিজয়তে ||

আনন্দ লহরী, শ্রীশঙ্করাচার্য

হয়গ্রীব বলতে লাগলেন, “ হে লোপামুদ্রাপতি অগস্ত্য, আমি এখন ভণ্ডাসুর বধের কাহিনি ব্যক্ত করব। শ্রবণ করো।”

সতীর দেহত্যাগ

পুরাকালে দক্ষ প্রজাপতির কন্যা পরাশক্তি সতীর সঙ্গে মহাদেবের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। বিবাহের পর থেকেই দাম্ভিক প্রজাপতি মহাদেবকে অপমান করতে থাকেন। দক্ষযজ্ঞে অন্যান্য সকল দেবতাদের আহ্বান জানানো হলেও শিব আমন্ত্রিত হননি। সতী পিতৃগৃহে গিয়ে পিতার কাছে এর কারণ জানতে চান। মোহান্ধ প্রজাপতি প্রবলতর উপায়ে পুনরায় শ্মশানচারী শিবের নিন্দা শুরু করেন। পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে সতী যজ্ঞস্থলে ধ্যানযোগে আত্মবিসর্জন দেন। এই সংবাদ পেয়ে প্রেমিক পতি মহাদেবের ক্রোধাগ্নিতে সমস্ত সৃষ্টি নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। তাঁর পিঙ্গল জটা থেকে জন্ম নেন ‘বীরভদ্র’। বীরভদ্র দক্ষের যজ্ঞস্থলে পৌঁছে যজ্ঞক্ষেত্র লণ্ডভণ্ড করেন ও দক্ষের শিরোশ্ছেদ করেন। বীরভদ্রের অন্তর্ধানের পর শিব যজ্ঞস্থলে পৌঁছে সতীর প্রাণহীন দেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয়নৃত্য শুরু করলে সমগ্র সৃষ্টি জুড়ে বিপর্যয় নেমে আসে। বিষ্ণু তখন সুদর্শন চক্র চালনে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করেন ও শিবকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। মহাদেব কৈলাস পর্বতে সমাধিমগ্ন হন।

        বহুকাল পরে গিরিরাজ হিমবন্ত ও মেনকার গৃহে সতী ‘পার্বতী’ রূপে জন্ম নেন। পার্বতী পুনরায় শিবকে পতিরূপে লাভ করার জন্য তপস্যা ও সেবা শুরু করেন। দেবতারাও এই পুনর্মিলনের জন্য অতি-আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু সমাধিমগ্ন যোগীশ্বর শিবের ধ্যান বা ব্রহ্মচর্য ভঙ্গ করতে তাঁরা সফল হলেন না।

        অন্যদিকে তারকাসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবগণ ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মা বিধান দিলেন, একমাত্র শিব-শক্তির মিলনজাত সন্তানই পারবে তারকাসুরকে বধ করতে। তাই যত শীঘ্র শিব-শক্তির পুনর্মিলন ঘটবে, ততই মঙ্গল। দেবরাজ ইন্দ্র মন্মথ অর্থাৎ কামদেবকে স্মরণ করলেন শিবের ব্রত ভঙ্গ করার জন্য।

        কামদেব শিবের নিবাসে উপস্থিত হলেন। বসন্তের বাতাস বইতে শুরু করল আশ্রমে। শিবসেবায় রত প্রমথগণ প্রেমোন্মত্ত হয়ে উঠলে নন্দী তাঁদের শান্ত করলেন। শিবের তখনও ধ্যান ভঙ্গ হয়নি, দেবী পার্বতীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এমতাবস্থায় মদনদেব শিবের হৃদয় লক্ষ করে কামবাণ নিক্ষেপ করলেন। শিবের ধ্যান ভঙ্গ হল, হৃদয়ে প্রেমের সঞ্চার হল। দেবী পার্বতী আনন্দিত হলেন।

        মহাদেব নিজের হৃদয়ের পরিবর্তন উপলব্ধি করে এর কারণ অনুসন্ধান করতে লাগলেন। মদনদেব লুকিয়ে থাকলেও শিবের দৃষ্টিগোচর হলেন। ক্রোধে শিবের তৃতীয় নয়ন উন্মুক্ত হয়ে অগ্নি বর্ষিত হল। সেই অগ্নিতে মদনদেব ভস্মীভূত হলেন। কামপত্নী রতি এই সংবাদে খুবই ভেঙে পড়লে হিমবন্ত নিজ কন্যা রতিকে নিয়ে গৃহে ফিরে গেলেন। সেখানে বসন্তদেব রতিকে ব্রহ্মার অভিশাপের কথা মনে করিয়ে দিলেন।

মন্মথের প্রতি ব্রহ্মার অভিশাপ

পুরাকালে শুণ্ড ও উপশুণ্ড নামের দুই দৈত্য তপস্যা করে ব্রহ্মার থেকে এক অদ্ভুত বর নিয়েছিল। বরটি ছিল এমন যে এরা দুজন পরস্পরকে বধ না করলে অন্য কেউ এদের বধ করতে পারবে না। এদিকে শুণ্ড ও উপশুণ্ড দুইজন অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু ছিল, তাই কার্যত তারা অবধ্য হয়ে উঠে স্বর্গরাজ্য তছনছ করতে লাগল। দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন।         ব্রহ্মা দেবতাদের সম্মুখেই পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য থেকে তিল তিল অংশ নিয়ে সৃষ্টি করলেন এক পরমাসুন্দরী নারী, ‘তিলোত্তমা’। তাঁর রূপে সকলে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। মন্মথও সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি মজা করে ব্রহ্মার প্রতি কামবাণ নিক্ষেপ করে বসলেন। ব্রহ্মাও কামোন্মত্ত হয়ে নিজপুত্রী তিলোত্তমাকে লক্ষ করেই ছুটতে লাগলেন। তিলোত্তমাও ছুটতে লাগলেন, ছুটতে ছুটতে তিনি হরিণীর রূপ ধারণ করলে, ব্রহ্মাও হরিণ রূপে ধাওয়া করলেন। ঠিক সেই সময়, শিব এক ভয়ংকর ব্যাধের বেশে তীরধনুক নিয়ে হরিণবেশী ব্রহ্মার গতি রোধ করলেন। শিবের দর্শনে ব্রহ্মার উন্মত্ততা কেটে গেল। তিনি শিবের অনুমতিক্রমে তিলোত্তমাকে শুণ্ড ও উপশুণ্ডের ভবনে প্রেরণ করলেন।

Subhadeep Saha

Subhadeep Saha is a Kolkata based freelance writer and commentator. He is an associate of The Saborno Sangrahalay - an evolving India studies resource centre in Kolkata.

0 Reviews

Related post