ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ৬

 ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ৬

হরিস্ত্বামারাধ্য প্রণতজনসৌভাগ্যজননীং

পুরা নারী ভূত্বা পুররিপুমপি ক্ষোভমনয়ৎ।

স্মরোঽপি ত্বাং নত্বা রতিনয়নলেহ্যেন বপুষা

মুনীনামপ্যন্তঃ প্রভবতি হি মোহায় মহতাম্।।

আনন্দ লহরী, শ্রীশঙ্করাচার্য

মোহিনী অবতার

“দৈত্য মলকাসুর ধন্বন্তরীর হাত থেকে সুবর্ণময় অমৃতকলসটি ছিনিয়ে নিতেই দেবাসুরের মধ্যে প্রচণ্ড কলহ সৃষ্টি হল। ভগবান বিষ্ণু তখন অভিন্নসত্তা ললিতার শরণাপন্ন হলেন। ভগবতীর ভাবনায় ভাবিত হলে ভগবান বিষ্ণু ভগবতীর সারূপ্য লাভ করলেন। শৃঙ্গার-রস-মণ্ডিতা, সর্বজনমোহিনী এক অপূর্ব স্ত্রীমূর্তি অবতীর্ণ হলেন। তিনি মধুর বচনে বললেন, “তোমরা কলহ করে কী পাবে? বরং ঐ অমৃতকুম্ভ আমাকে সমর্পণ করো। আমি তোমাদের সকলকে এই অমৃত সমভাবে বণ্টন করে দেব, তোমরা পান করো।” দৈত্যগণ সেই মধুর কণ্ঠে বিমোহিত হয়ে দেবীর হাতে সুধাপাত্র তুলে দিলেন।”

“দেবী মোহিনী সেই সুধাপাত্র হাতে নিয়ে দেব এবং দৈত্যকে সমান্তরাল দুটি পঙ্‌ক্তিতে বসিয়ে নিজে মাঝখানে দাঁড়ালেন। দেবীর মঙ্গলকঙ্কণের ধ্বনি সমস্ত জগতকে সম্মোহিত করল। তাঁর ডান হাতে সুবর্ণদর্বী (পরিবেশনের হাতা) ও বামহাতে সুবর্ণকলস রয়েছে। তিনি প্রথমে দেবগণের পঙ্‌ক্তিতে পরিবেশন শুরু করলেন।”

“দেবতাদের অমৃত পরিবেশ করতে দেখে সিংহিকা-পুত্র দৈত্য রাহু দেবতার বেশে দেবতাদের পঙ্‌ক্তিতেই উপস্থিত হয়েছিল। যখন রাহুকে অমৃত দেওয়া হচ্ছে, সূর্য এবং চন্দ্রদেব চিনতে পেরে দেবীকে সূচিত করলেন। দেবী তৎক্ষণাৎ দর্বীকরে রাহুর মস্তক ছেদ করলেন। যেহেতু রাহুর গলদেশ পর্যন্ত অমৃত পৌঁছে গিয়েছিল, তাই দেহহীন রাহু অমর হয়ে রইল। তখনও দৈত্যকুল দেবী মোহিনীর উপস্থিতিতে সম্মোহিত হয়ে ছিল। দেবী দেবগণকে সমস্ত অমৃত পরিবেশন করে শূন্য পাত্র দৈত্যদের সামনে রেখে অন্তর্হিত হলেন। দৈত্যগণ তখন সচকিত হয়ে দেখল, সমস্ত অমৃত নিঃশেষিত হয়েছে। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তারা দেবতাদের উপর আক্রমণ করে বসল। এদিকে দেবতারাও অমৃতগুণে সবল হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা দৈত্যদের পরাস্ত করে স্বর্গরাজ্যের অধিকার ছিনিয়ে নিল। পুনরায় সমৃদ্ধিতে ভরে উঠল ত্রিভুবন।”        

“অন্যদিকে নারদমুনির কাছে সমস্ত বিবরণ শুনে কৈলাসপতি শিব ও দেবী পার্বতী বৈকুণ্ঠে আসেন শ্রীবিষ্ণুর নিকটে। মহাদেব বিষ্ণুর কাছে মোহিনী অবতারের বিষয়ে ঔৎসুক্য প্রকাশ করেন। মহাদেব দেবী মোহিনীকে চাক্ষুষ করার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন। বিষ্ণুকে অনুরোধ করা হলে তিনি কিছু না বলেই অন্তর্হিত হলেন। ভগবান শিবও শ্রীবিষ্ণুর সন্ধান করতে লাগলেন। খুঁজতে খুঁজতে এক রমণীয় উদ্যান তাঁর নয়নগোচর হল। সেখানে অশোক, চম্পক প্রভৃতি নানা বৃক্ষের শোভায় উদ্যানটি সুরভিত। ভ্রমরের গুঞ্জনে ময়ূরের নৃত্যে সেই স্থানে মনোরম পরিবেশ রচিত হয়েছে। বিকশিত কুসুমের ছটায় চারিদিক বর্ণময় হয়ে উঠেছে। কমল সরোবরের তীরে মনোহর পারিজাত বৃক্ষের নিচে এক পরম রূপবতী নারী বীণাবাদন করছেন। উদিত সূর্যের আভা তাঁর দেহ ঘিরে আন্দোলিত হচ্ছে। চরণযুগল কমলের ন্যায় কোমল, তাতে মঞ্জীর ধ্বনিত হচ্ছে। তাঁর সুচারু কটিতট যেন কামবাণের তুণীর। ঊরুদ্বয় যেন ‘করীশুণ্ড-কদলী-কান্তি’! অরুণ দুকূলে তনু আচ্ছাদিত হয়েছে। নত নাভিদেশে ত্রিবলী বলয় রচিত হয়েছে। উন্নত বক্ষে মুক্তাহারের হিন্দোল উঠেছে আর সুকোমল করে মাণিক্যময় কঙ্কণের ধ্বনি রণিত হচ্ছে। সুন্দর আননে শুচিশুভ্র হাসি, কম্বুকণ্ঠ, কেতকীর অন্তর্দলের মতো আঁখি, কর্ণে মাণিক্যকুণ্ডল, ললাটে কস্তুরী-তিলক, নীলাভ কেশদামের সীমান্তদেশে সিন্দূর আর তীক্ষ্ন নাসিকায় মুক্তার আভরণ—শৃঙ্গারবেশে সুসজ্জিতা দেবী মোহিনী মহেশ্বরের হৃদয় হরণ করলেন। দেবী মোহিনীর নানা ছলচাতুর্যে মহেশ্বর মধুররসে স্নাত হলেন। মোহিনী-মহেশ্বরের মিলন সম্পন্ন হল। মহেশ্বরের বীররস থেকে জন্ম নিলেন দৈত্যদলনকারী ধর্মশস্ত আইয়াপ্পা।”

শিব ও মোহিনী

Subhadeep Saha

Subhadeep Saha is a Kolkata based freelance writer and commentator. He is an associate of The Saborno Sangrahalay - an evolving India studies resource centre in Kolkata.

0 Reviews

Related post