ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ৫

 ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ৫

Tripura Sundari Lalitha

ত্বদন্যঃ পাণিভ্যামভয়বরদো দৈবতগণঃ

ত্বমেকা নৈবাসি প্রকটিতবরাভীত্যভিনয়া ।

ভয়াৎ ত্রাতুং দাতুং ফলমপি চ বাঞ্ছাসমধিকং

শরণ্যে লোকানাং তব হি চরণাবেব নিপুণৌ।।

আনন্দ লহরী, শ্রীশঙ্করাচার্য

ইন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে মদ্যপান ও পরনারীগমন সংক্রান্ত পাপের কথা জানতে চাইলেন। বৃহস্পতি বললেন, “পৈষ্টিক, তালজ, কৈর, মাধ্বী, গুড়সম্ভব ইত্যাদি নানা প্রকারের সুরা রয়েছে। বৃথাপান অর্থাৎ দেবতাকে অর্পণ না করে আসব পান করা সর্বথা নিন্দনীয় ও গর্হিত অপরাধ। ভগবতীকে অর্পণের পর নির্দিষ্ট পরিমাণে গ্রহণ করলেই তা মঙ্গল। ভোগের ইচ্ছায় যে পান করে তার নরকবাস হয়। অনূঢ়া কন্যা, পতিহীনা নারী ও রজঃস্বলা নারী কখনও সোম গ্রহণ করবে না। অধিকারী যদি পরাশক্তির আরাধনা না করে বৃথাপান করে, তবে তার রৌরব নরকবাস হয়।”

    “গুরুপত্নী বা অভিভাবিকা-স্থানীয়া নারীর সঙ্গে গমন পাপ। রজঃস্বলা স্ত্রী-র সঙ্গে রমণও অপরাধ।”

    “ব্রহ্ম থেকে কীট, সকলেই খাদ্য, কাম, নিদ্রা এবং কামনায় বশীভূত। খাদ্য বিনা জীবের জীবনধারণ অসম্ভব, আবার খাদ্যের অভাব মিটলেই জীবের অন্য সুখের চাহিদা আসে। চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা অতীব কঠিন কাজ। পুরাকালে ভগবান বিষ্ণুর ইচ্ছায় ব্রহ্মা জগৎ সৃজন করেছিলেন। ব্রহ্মা মন্মথের সাহায্যে নারী-পুরুষ ভেদে জীব সৃষ্টি করেছিলেন যাতে প্রকৃতির নিয়মে জন্ম-মৃত্যুর ধারা বজায় থাকে। তাই প্রবৃত্তিই জগতের মূল, প্রবৃত্তি বিনা জগতের ধ্বংস অনিবার্য। কেবল নিবৃত্তি নয়, প্রবৃত্তির মাধ্যমেও মুক্তির উপায় সম্ভব। এই মার্গ গোপনীয়।”

    “অবিচল বাসুদেব ‘সৎ’ পুরুষরূপে যদি সকলের আত্মরূপ হন, তবে অনন্তশক্তি ভগবতী চঞ্চল ‘চিৎ-শক্তি’ রূপে তাঁর বাহ্যিক আন্দোলন। সৃষ্টিতত্ত্বের সামঞ্জস্য রক্ষার্থে এই পুরুষ-প্রকৃতি অবিরাম রমণ করে চলেছেন। মনুষ্য জীব এই ভাবনাকে স্মরণ করে মিলন করলে তা সাধনে পর্যবসিত হয়। পুরুষ আপনাকে ভগবানের অংশ এবং তার স্বশক্তি আপনাকে ভগবতীর অংশ, এই বিচার করে যদি সেই পুরুষ-প্রকৃতির মিলনকে হৃদয়ে রেখে রতিক্রিয়া করে, তবে তা আত্মিক সুখের কারণ হয়।”

সকল কিছু অবগত হবার পর ইন্দ্র বললেন, “হে দেবগুরু আপনি অন্তর্যামী। আপনার কাছে এই সকল ব্যাখ্যা শুনে আমি ঋদ্ধ হয়েছি। দয়া করে এখন বলুন, ঠিক কোন পাপে আজ আমার এই দুরবস্থা।”

বৃহস্পতি বললেন, “একদা ঋষি কশ্যপ ও দিতির কন্যার গর্ভে ব্রহ্মার ঔরসে জন্ম নিয়েছিলেন বেদজ্ঞ বিশ্বরূপ। তিনি বাসুদেবের উপাসক ও তপস্বী ছিলেন। দৈত্যগণ যখন শুক্রাচার্যকে গুরুরূপে বরণ করলেন, দেবগণও তখন বিশ্বরূপকে গুরুরূপে বরণ করলেন। দেবদৈত্যের বিবাদে কখনও দৈত্যদের প্রতি অহেতুক বৈরিতা প্রদর্শন করেননি। তাঁর পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু, হে ইন্দ্র, নিজ ঐশ্বর্য হারানোর ভয়ে তুমি তাঁকে তপস্যারত অবস্থায় শিরশ্ছেদ করে হত্যা করেছ, কেবল তিনি পক্ষপাতদুষ্ট, এই সন্দেহের বশবর্তী হয়ে। এতে তোমার গুরুহত্যার আর ব্রহ্মহত্যার পাপ তো হয়েছেই, উপরন্তু পুত্রশোকে ব্যথিত ব্রহ্মাও তোমাকে শ্রীহীন হবার অভিশাপ দিয়েছিলেন। আর অধুনা তোমার মদগর্বে টলে উঠেছিল মহাদেবের কৈলাস। তিনিই দুর্বাসাকে আহ্বান করেছিলেন। আর তোমার অহংকারের পরিণতি তুমি নিজেই দেখতে পাচ্ছো।”

হয়গ্রীব অগস্ত্যকে বললেন, “এভাবেই বৃহস্পতি ইন্দ্রের কাছে সমস্ত বিবরণ ব্যক্ত করলেন। অন্যদিকে দেবগণকে দুর্বল দেখে দৈত্যগণ স্বর্গরাজ্য আক্রমণ করে তছনছ করে দিল। ইন্দ্র তখন নিরুপায় হয়ে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মা সকল দেবগণকে নিয়ে ক্ষীরসাগরে শায়িত ভগবান বাসুদেবের নিকটে এসে স্তুতিনতি জানালেন। ভগবান বললেন, “হে দেবগণ, তোমরা এই ক্ষীরসমুদ্র মন্থন করো। মন্দার পর্বতকে মন্থনদণ্ড, নাগরাজ বাসুকিকে রজ্জু করে মন্থন করলে তোমাদের অভিপ্রায় পূর্ণ হবে। আমি স্বয়ং কূর্ম অবতারে মন্দার পর্বতকে ধারণ করব। সমুদ্র মন্থনের শেষে যে অমৃত উঠে আসবে, তা তোমাদের অজেয়, অমর করবে। তবে এই কাজে দানবদের সাহায্য প্রয়োজন হবে। যাও, তাদের এই কাজে আহ্বান জানাও। বাকি উপায় আমিই করব।”

    “অতঃপর মন্থন প্রক্রিয়া শুরু হল। ভগবান বিষ্ণু নিজে কূর্মাকার হয়ে পর্বতকে সমুদ্রে ধারণ করলেন। আবার বাসুকি, দেবগণ তথা দৈত্যগণের মধ্যেও শক্তি সঞ্চারিত করে এক অসম্ভব কার্য সম্ভব করলেন। মন্থনে ক্রমে ক্রমে উঠে আসতে লাগল, সুরভি, বারুণী, পারিজাত বৃক্ষ, অপ্সরা, চন্দ্র, কালকূট, কৌস্তভমণি প্রভৃতি।”

    “বারুণী অর্থাৎ সুরা গ্রহণ করে দেবতারা আরো শক্তিশালী হলেন। অসুরেরা এসব কিছুই গ্রহণ করল না। তাদের কেবল অমৃতের প্রতি আসক্তি। এরপর অমৃতকলস হাতে ধন্বন্তরী ও পদ্মালয়া লক্ষ্মী দেবী সমুদ্র থেকে উঠে এলেন। দেবগণ শ্রীসূক্ত পাঠ করে দেবীর বন্দনা করলেন। গঙ্গাদি দেবীগণ তাঁকে স্নান করানোর জন্য এলেন। ভগবান বিষ্ণু তাঁকে নিজ হৃদয়ে অধিষ্ঠান করালেন। দানবগণ এই সুযোগে ধন্বন্তরীর হাত থেকে অমৃত কলস ছিনিয়ে নিল।”

Subhadeep Saha

Subhadeep Saha is a Kolkata based freelance writer and commentator. He is an associate of The Saborno Sangrahalay - an evolving India studies resource centre in Kolkata.

0 Reviews

Related post