ললিতা-উপাখ্যান—ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন-৪

 ললিতা-উপাখ্যান—ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন-৪

কিং বর্ণয়াম তব রূপং-অচিন্ত্যং-এতৎ,

কিঞ্চাতি বীর্যং-অসুর-ক্ষয়কারি ভূরি।

কিঞ্চাহবেষু চরিতানি তবাতি যানি

সর্বেষু দেব্যসুর-দেবগণাদিকেষু।।

শক্রাদিকৃত দেবীস্তুতি, শ্রীশ্রীচণ্ডী

দেবরাজ ইন্দ্রের প্রতি দুর্বাসার অভিশাপ

মহামায়া অশেষ মায়া থেকে স্বর্গের দেবগণেরও নিষ্কৃতি নেই। স্বর্গরাজ্যের অতুল ঐশ্বর্যের অহংকারে বারংবার তাঁরা নিজেকে ত্রিজগতের অধিপতি ভেবে বসেন। স্বর্গও যে মহামায়ারই মায়া, তা তাঁরা বোঝেন না। মোহান্ধতার বশে নানাবিধ ভুল করে বসেন। তখনই সেই ভুল শোধরাতে লীলাময়ী মহামায়াকে লীলা বিস্তার করতে হয়। আদতে এই কাহিনি দেবতাদের নিয়ে হলেও এই কাহিনি যতখানি দেবতার, ততখানি মানুষেরও। সর্বশক্তিমানের অসীমতা বিস্মৃত হয়ে আমরা আমাদের সীমিত ক্ষমতার সীমাহীন দম্ভের উদ্‌যাপন করি।

    মহর্ষি হয়গ্রীব বললেন, “হে অগস্ত্য, বিজয়শ্রী ও নিত্যশ্রীর কৃপায় সমৃদ্ধ, স্বর্গরাজ্যের অধিপতি ইন্দ্র কৈলাসপর্বতের মতো সুউচ্চ এক হাতির পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তাঁর মদগর্ব নিবারণের জন্য কৈলাসপতি শিব ঋষি দুর্বাসাকে আবাহন করলেন। মৃগচর্ম-পরিহিত, দণ্ডধারী, ভস্মসিত তেজস্বী দুর্বাসা বিদ্যাধরদের রাস্তা দিয়ে স্বর্গে আসছিলেন। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন এক বিদ্যাধরী, তাঁর হাতে একটি দিব্যমালা, মুখে প্রসন্ন হাসি। ঋষিকে প্রণাম করলে ঋষি সেই দিব্যমালার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। বিদ্যাধরী বললেন তিনি মহামায়ার তপস্যায় নিযুক্ত ছিলেন, সেই মহামায়াই তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে এই মালা তাঁকে দিয়েছেন। ঋষিবর ভগবতীর একনিষ্ঠ ভক্ত, এই বাক্য শুনে ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে গেলেন। তা দেখে বিদ্যাধরী সেই মালাটি ঋষিবরের হাতে সমর্পণ করে, প্রণাম করে চলে গেলেন। এক বিদ্যাধরবধূ এসে তাঁকে দিব্যগন্ধ এবং ‘বল্লকি’ নামের এক বীণা উপহার দিলেন। ঋষি দুর্বাসাও অত্যন্ত সন্তুষ্ট চিত্তে হাতে মালা আর বীণা নিয়ে গান গাইতে গাইতে আবার পথ চলতে শুরু করলেন।”

    “পথে যেতে যেতেই তিনি ইন্দ্রের সুবিশাল ঐরাবতের সামনে পড়লেন। প্রসন্নচিত্ত দুর্বাসা ঐ দিব্যমাল্য ইন্দ্রকে উপহার হিসেবে দিলেন। ইন্দ্র দম্ভভরে সেই মালা ঐরাবতের গলায় দিয়ে দিলেন। অবোধ ঐরাবত সেই মালা শুঁড় দিয়ে টেনে নামিয়ে পদদলিত করল। এই ঘটনা দেখে দুর্বাসা ক্রোধে রক্তবর্ণ হয়ে গেলেন। তিনি ইন্দ্রকে অভিশাপ দিলেন, যে মালা মহাদেবী ধারণ করেছিলেন, ব্রহ্মাদি দেবগণ যে মালা পেলে আনন্দে পূজা করত, সেই মালা দুর্বাসা ইন্দ্রের শিরে অর্পণ করেছিলেন, ইন্দ্র ঐশ্বর্যে মত্ত হয়ে সেই মালাকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন, তাই সেই ঐশ্বর্য অচিরেই বিনষ্ট হবে। দুর্বাসার শাপে বিজয়শ্রী পাতালে চলে গেলেন আর নিত্যশ্রী ভগবান বাসুদেবের কাছে চলে গেলেন। ত্রিলোক শ্রীহীন হয়ে গেল।”

ইন্দ্র-বৃহস্পতি সংবাদ

শাপগ্রস্ত ইন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতিকে আবাহন করলেন। ধর্মাধর্ম সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হল।

ইন্দ্র: “হে দেবগুরু! আপনি সকল ধর্মের জ্ঞাতা, ত্রিকালজ্ঞ। আজ যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, আমি জানি না তা কী কারণে ঘটল, আমি এও জানি না যে এর থেকে মুক্তির উপায় কী!”

বৃহস্পতি: “হে রাজন্, আপন কর্মের ফল ভোগ না করলে বা প্রায়শ্চিত্ত না করলে তা শতকোটিকল্পেও বিনষ্ট হয় না।”

ইন্দ্র: “কর্ম কীরূপ গুরুদেব? প্রায়শ্চিত্তই বা কীরূপ? দয়া করে বিস্তারিত বলুন।”

বৃহস্পতি: “রাজার দুষ্কর্ম পাঁচ প্রকারের: হনন, চৌর্য, হিংসা, পানোন্মত্ততা, পরনারীগমন। হে রাজন্ মনে রাখবেন, দানব বা সাধারণ জীবের কৃত পাপ যদি জ্ঞানী বা দেবতা করেন, তাতে দুষ্কর্মের ফল সহস্রগুণ বৃদ্ধি পায়।

হনন ও হিংসা: যদি প্রজাকে রক্ষা করতে হিংস্র প্রাণীকে হনন করা হয়, তবে তাতে পাপ হয় না। সমষ্টিকে রক্ষা করতে যদি ব্যক্তিকে হনন করতে হয়, তবে তাতে অধর্ম হয় না। যদি আত্মীয়-পরিজন বা বন্ধুর রক্ষার জন্য হনন করতে হয়, তবে তাতে পাপের এক-চতুর্থাংশ ভোগ করতে হয়। যদি আত্মরক্ষার জন্য হনন করতে হয়, তবে পাপের ফল অর্ধেক ভোগ করতে হয়। স্ত্রী-পুত্র-বন্ধু-ভাই এদের ক্ষতি হলে পাপ দশগুণ বৃদ্ধি হয়। আবার শুধু নিজের উদরপূর্তির জন্য প্রাণিহিংসা করলে তা পাপ হয়। সমাজকল্যাণের জন্য, ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য বা যজ্ঞার্থে হিংসা করলে পাপ হয় না।

চৌর্য: শাস্ত্র বলে, শরণাগত যে তার ক্ষতি করার মতো পাপ আর কিছুই নেই। জ্ঞানী এবং পরিশ্রমী মানুষের সম্পদ চুরি করাও পাপ। স্ত্রী-বহুপুত্রসম্পন্ন মানুষের সম্পদ অথবা কারোর পূর্বসঞ্চিত সম্পদ, যে বর্তমানে উপার্জনে অক্ষম, তেমন সম্পদ চুরি করাও পাপ। এমন পাপীদের কঠিনতম শাস্তি দেওয়াই রাজার ধর্ম ও পুণ্য।

হে ইন্দ্র এই প্রসঙ্গে একটি কাহিনি বর্ণনা করি, শ্রবণ করো।”

বীরদন্ত কিরাতের কাহিনি

বহুকাল পূর্বে কাঞ্চীনগরে বজ্র নামে এক ডাকাত ছিল। সেই নগরে সমস্ত সম্পদবান ধনী মানুষেরা বসবাস করতেন। বজ্র সেই সমস্ত ধনীদের বাড়ি থেকে চুরি-ডাকাতি করে প্রচুর সম্পদ জমা করেছিল একটি জঙ্গলে গাছের কোটরে। গাছটি সে পাথর দিয়ে চিহ্নিত করে রেখেছিল। রাতের বেলা চুরি করা জিনিস রেখে সে চলে যায় রোজ। একদিন বীরদন্ত নামের এক কিরাত বনে গিয়ে খাদ্য আহরণ করতে করতে সেই প্রভূত সম্পদ দেখে ফেলে। কিরাত সেই সম্পদের দশভাগের একভাগ বাড়িতে নিয়ে আসে। সে তার স্ত্রীকে বলে, “তোমার তো ধনসম্পদ সঞ্চয়ের অভিলাষ ছিল, দেখো আজ বনে গিয়ে আমি এই সম্পদ পেয়েছি। এটা তুমি রেখে দাও।” কিরাতিনী বলল, “এক সাধু মাধুকরী করতে এসে বলেছিলেন, আমার ভাগ্যে লক্ষ্মীযোগ আছে। কিন্তু আমাদের গৃহে কি এই সম্পদ রাখা শোভা পায়? তিনি এও বলেছিলেন, যে সম্পদ অনায়াসে পাওয়া যায়, সে সম্পদ কখনও স্থির হয় না। যে সম্পদ পরিশ্রমের দ্বারা ধীরে ধীরে আয়ত্ত হয়, তা-ই স্থির হয়। এই সম্পদ তুমি বিনা আয়াসেই লাভ করেছ, তাই এই সম্পদ সঞ্চয় না করে লোকহিতার্থে ব্যয় করাই উচিৎ কাজ হবে।” বীরদন্তও এতে সম্মত হল। অনেক ভেবেচিন্তে তারা স্থির করল যে রাজ্যে যেখানে জলসংকট আছে, তেমন এক স্থানে তারা সুগভীর এক পুষ্করিণী খনন করবে। যথারীতি কাজ শুরু হল। কাজ যখন প্রায় শেষের পথে, তখন সেই সম্পদ শেষ হয়ে গেল। বীরদন্ত আবার সেই বন থেকে কিছু কিছু অংশ এনে কাজটি সমাধা করল। পুষ্করিণীর মাঝখানে, চতুর্দিকে জলের মধ্যে নির্মিত হল একটি সুরম্য বিষ্ণুমন্দির। যাদের প্রয়োজন তাদের অর্থও দান করা হল। জঙ্গল পরিষ্কার হয়ে গড়ে উঠল ‘দেবরথপুর’ নামে এক বসতি। এমনভাবেই ওই সম্পদ লোকহিতার্থে ব্যয় হল। কাঞ্চীর পণ্ডিতগণ তাদের ‘দ্বিজবর্মা’ ও ‘শিলাবতী’ উপাধিতে ভূষিত করলেন।

    বহুদিন পর শিলাবতী ও দ্বিজবর্মা দুজনেই একসঙ্গে মারা গেল। যমদূত, বিষ্ণুদূত ও শিবদূতের মধ্যে বচসা শুরু হল। কে এই দুজনের আত্মাকে তাদের লোকে নিয়ে যাবে, তাই নিয়েই বচসা। দেবর্ষি নারদ এলেন মধ্যস্থতা করতে। নারদ বললেন, “বীরদন্ত পুণ্যবান ঠিকই, তবে সে চুরির অর্থ দান করেছে। তাই যতদিন না ঐসব সম্পদের মালিকদের মৃত্যু হচ্ছে, ততদিন সে পৃথিবীতেই ঘুরে বেড়াবে। শিলাবতী কোনও পাপ করেনি, সে শিবভক্ত, তাই শিবদূতেরা তাকে নিয়ে যেতে পারে।” এই কথা শুনে শিলাবতী বলল, “হে দেবর্ষি, আমি আমার পতিকে ছাড়া শিবলোকে যেতে পারব না। যদি এমন কোনও উপায় থাকে, যা করলে আমার স্বামী পাপমুক্ত হবে, তবে তা করতে আমি সম্মত, দয়া করে সেই উপায় বলুন।” নারদ তখন শিলাবতীকে শিবমন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে জপ করার নির্দেশ দিলেন। সেই পুণ্যপ্রভাবে শিলাবতী বীরদন্তের সঙ্গে কৈলাসে শিবলোকে গেলেন।

    এরপর বজ্র ও ঐ সম্পদের মালিকেরা সকলে মারা গেলে যমদূত তাদের নিয়ে এল। যমরাজ বললেন, “বীরদন্ত ও শীলাবতী শিবলোকে রয়েছে। আর তোমরা পুণ্য করতে না চাইলেও তোমাদের সম্পদে তারা পুণ্যকার্য করেছে। তাই এই পুণ্যের ভাগ তোমরাও পাবে। তোমরা যমালয়ে থেকে পাপ ভোগ করবে আগে? নাকি শিবলোকে গিয়ে পুণ্য ভোগ করবে আগে?” সকলে সম্মিলিতভাবে বলল, “আমরা শিবলোকে আগে যেতে চাই, সেখানে সেই মহাত্মার সঙ্গ চাই, যাঁর কর্মপ্রভাবে আমরা পুণ্যবান হয়েছি!” যমরাজ এই উত্তর শুনে খুশি হলেন। তারপর সকলে মিলে শিবলোকে গিয়ে বীরদন্ত ও শিলাবতীর সঙ্গ করে সকল পাপ থেকে মুক্ত হয়ে কৈলাসেই স্থায়ীভাবে রয়ে গেল।”

বৃহস্পতি বললেন, “হে ইন্দ্র, সৎসঙ্গেও পাপ বিনষ্ট হতে পারে।”

Subhadeep Saha

Subhadeep Saha is a Kolkata based freelance writer and commentator. He is an associate of The Saborno Sangrahalay - an evolving India studies resource centre in Kolkata.

0 Reviews

Related post