ললিতা-উপাখ্যান—ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন-৩

 ললিতা-উপাখ্যান—ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন-৩

বন্দি গণনাথ সিদ্ধিপতির চরণ।

বিঘ্ন নাশো রচয়িতে ললিতা-কথন।।

ব্রহ্মাণ্ড-পুরাণ মাঝে অন্ত্যখণ্ড নাম।

ব্যাসে রচে ললিতার লীলা অভিরাম।।

বন্দি আমি দেবনাথ দেশিক-চরণ।

কালীদাসে মিলালেন ইষ্টের শরণ।।

শুভদীপ

অভিন্নশক্তি গণপতি, গুরু ও ইষ্টের আজ্ঞানুক্রমে আমরা আজ প্রবেশ করব ব্যাসপ্রোক্ত ব্রহ্মাণ্ডপুরাণের অন্ত্যখণ্ডে ললিতা-উপাখ্যান শীর্ষক অধ্যায়ে। আস্বাদন করব ভগবতীর দিব্যলীলা ও কাহিনি।


অগস্ত্যের বিষ্ণুদর্শন

দেবর্ষি অগস্ত্য ছিলেন বেদ-বেদাঙ্গে বিশারদ, সর্বশাস্ত্রসিদ্ধান্ত-জ্ঞাতা, ব্রহ্মানন্দ-রসের রসিক। পুরাকালে লোককল্যাণের লক্ষ্যে তিনি পদব্রজে তীর্থযাত্রা আরম্ভ করেন। হিমালয় থেকে বহু অরণ্য, পর্বত, জনপদ ঘুরে তিনি দেখলেন, সংসার কেবল ভোগের পরাকাষ্ঠা। উদর আর ইন্দ্রিয়ের সেবা ছাড়া অন্য বিষয়ে কারো কোনও আগ্রহ নেই। দেবর্ষি অত্যন্ত চিন্তিত হৃদয়ে এসে পৌঁছালেন কাঞ্চীপুর-ধামে। এই মহাপুণ্যময় ভূমির বারণ-শৈল নামক স্থানে ধ্যানময় একাম্বরনাথ শিব এবং কলিকল্মষহারিণী কামাক্ষী দেবীর অবস্থান। একটি আমগাছের নিচে বসে চিন্তিত দেবর্ষি অগস্ত্য মঙ্গলময় ভগবান বিষ্ণুর তপস্যা শুরু করলেন।

দেবর্ষির তপস্যায় তুষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণু তাঁর হয়গ্রীব রূপে আবির্ভূত হলেন, অপূর্ব সুন্দর তাঁর চিন্ময় বিগ্রহ দেখে দেবর্ষি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। হয়মুখ মহাবিষ্ণু, চতুর্ভুজে যিনি শঙ্খ, চক্র, জপমালা ও বেদ ধারণ করে আছেন, তিনি বেদের রক্ষক, ত্রিজগতের পালক, যাঁর কারুণ্যে ত্রিভুবন আলোকোজ্জ্বল হয়েছে। করুণাময় লোকপালক শ্রীবিষ্ণুর চরণে দেবর্ষি অগস্ত্য বারংবার প্রণত হলেন। প্রভু জগন্নাথ তখন বললেন, “হে ঋষিশ্রেষ্ঠ অগস্ত্য, আমি তোমার তপস্যায় তুষ্ট হয়েছি। বর প্রার্থনা করো।” দেবর্ষি বললেন, “হে শ্রীনাথ, আমার অন্য বরের আকাঙ্ক্ষা নেই। যদি আপনি আমার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন তবে লোককল্যাণের জন্য আমায় এমন বিদ্যা উপদেশ করুন, যাতে এই সংসার পশুত্ব থেকে মুক্তি পায়। কী উপায়ে এই সংসারবদ্ধ জীব পশুপাশ থেকে মুক্ত হতে পারে?” শ্রীবিষ্ণু তখন অগস্ত্যকে বললেন, “এই প্রশ্ন ভগবান শিব এবং ব্রহ্মাও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। ঋষি দুর্বাসাও একই প্রশ্ন করেছিলেন, আজ তুমিও সেই প্রশ্ন করলে। হে অগস্ত্য, তোমার এই জিজ্ঞাসার কারণ, তোমার মহানুভবতা, তোমার তাপস-চিত্ত। তুমি লোকগুরু, তাই লোকচিন্তায় এই প্রশ্ন করেছ। মানবকল্যাণের স্বার্থে তোমার এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই আমি তোমাকে দেব। এই জগতের আদিসত্তা আমিই। আমি সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারের কর্তা, ত্রিদেবের দেবও আমিই। কখনও সত্ত্বরজস্তমো এই ত্রিগুণময়, কখনও নির্গুণ, আবার কখনও ত্রিগুণাতীত। আমিই আবার সকল গুণের আশ্রয়। আমার ইচ্ছাতেই জগত চালিত হয়। আমিই সৎ-চিৎ রূপে সর্বভূতে, সৃষ্টিতে আবার সৃষ্টির বাইরেও বিচরণ করি। তাই, আমার উপদেশ জগতের কাছে বর-রূপেই প্রসিদ্ধ।”

শ্রীবিষ্ণু আরও বললেন, “হে ঋষিবর এই ‘চিৎ’ রূপেই আমি সমস্ত লোকে ত্রিগুণাত্মক চৈতন্যস্বরূপ (সর্বভূতগুণাত্মক)। আর ‘সৎ’ রূপে আমিই ত্রিগুণাতীত, অপ্রকাশ্য, সর্বশক্তিময় সত্তা। কিন্তু এই ‘সৎ’ এবং ‘চিৎ’ একই ব্রহ্মসত্তা (সচ্চিদেকং ব্রহ্ম)। আমার অপ্রকাশ্য সত্তার সাধন অতি কঠোর, জ্ঞান-যোগের মাধ্যমে তা পাওয়া সম্ভব। আর যে শক্তি নিয়ত ক্রিয়াশীল, তা আমার চিৎ-শক্তি। কর্ম অথবা কর্মত্যাগের মাধ্যমে তাঁর সাধন সম্ভব। কর্মত্যাগও অতি কঠিন, বিবেক ও বৈরাগ্য উদয় না হলে ঠিক-ঠিক হয় না। আর কর্মযোগ জীবের পক্ষে অতি সহজ, শুধুমাত্র সৎ-অসৎ বিচারের মধ্যে সাধনোপায় নিহিত রয়েছে।”

“সৎ-চিৎ স্বরূপ সর্বব্যাপী পরমাত্মা। পরমাত্মার বোধ এবং সর্বব্যাপকতার বিশ্বাস থেকেই সাধক সকল সিদ্ধি অর্জন করে। এই নিত্য ক্রিয়াশীল পরমাত্মাই পরাশক্তি ললিতা ত্রিপুরসুন্দরীর স্বরূপ, যিনি স্থূল, সূক্ষ্ম ও কার্যকারণরূপে অবস্থিত। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জীব আপন আত্মশক্তির স্বরূপ এই দিব্যচৈতন্য, চিদ্‌রূপিণী ললিতা রাজরাজেশ্বরী মহাত্রিপুরসুন্দরীর সাধন করতে সমর্থ।”

“বিধিবিধানে পূজা না করেও পুরুষোত্তমের পরাশক্তি রূপ নিঃসংশয় এবং অভিন্নভাবনায় কেবলমাত্র ধ্যান করলেই পবিত্রতা, সমৃদ্ধি এবং অন্তিমে মুক্তি লাভ হয়। জীব জন্ম-মৃত্যুর চক্র হতে মুক্ত হয়। ভোগ ও মোক্ষ উভয় প্রাপ্তির একমাত্র উপায় ত্রিপুরাসুন্দরীর সাধন।”

“হে মুনিবর, আমি তোমার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে এই পরাবিদ্যার কথা তোমায় শ্রবণ করালাম। দেব, মুনি, সিদ্ধ, মনুষ্য অথবা যে-কেউ এই শক্তির সাধনায় পরতর সিদ্ধি লাভ করবে।”

এহেন বাক্যে প্রেমাপ্লুত দেবর্ষি অগস্ত্য শ্রীবিষ্ণুর চরণে প্রণত হয়ে বললেন, “হে প্রভু, দয়া করে আমাকে বলুন, কে এই ললিতা ত্রিপুরাসুন্দরী? কীভাবে আর কেনই বা তাঁর এই রূপ, দয়া করে আমাকে বলুন।”

জনার্দন হয়গ্রীব শ্রীবিষ্ণু আপন অংশ থেকে সৃষ্টি করেছিলেন মহর্ষি হয়গ্রীবকে। শ্রীবিষ্ণু বললেন, “হে অগস্ত্য, আমারই অংশসম্ভূত মহর্ষি হয়গ্রীব সর্বজ্ঞ, জ্ঞান এবং করুণার সাক্ষাৎ বিগ্রহ। মহর্ষিই তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার যোগ্য ও অধিকারী। আমাকে বিদায় দাও।”

দেবর্ষি প্রণত চিত্তে বিদায় সম্ভাষণ করলে শ্রীবিষ্ণু অন্তর্হিত হলেন।

 

হয়গ্রীব-অগস্ত্য সংবাদ

মহর্ষি হয়গ্রীবকে সঙ্গে নিয়ে অগস্ত্য এলেন আপন আশ্রমে। যথারীতি বিধানে অতিথি ঋষির পাদপূজা করে, সেবা করে, দিব্য আসনে উপবেশন করালেন। তারপর নানাবিধ স্তুতিবাক্যে তাঁকে তুষ্ট করে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে ভগবান, বহুকৃত পুণ্যফলে, অভ্যুদয়ের কারণবশত, জীব আপনার দর্শনে সমর্থ হয়। দয়া করে দেবী ললিতার আবির্ভাব, দিব্য অবতারত্ব ও মুখ্যলীলাসকল আমাকে শ্রবণ করান।”

হয়গ্রীব বললেন, “ত্রিলোকের আদি জননী, যিনি কেবল ধ্যান ও মননের দ্বারা প্রতিভাত হয়, তিনি ললিতা। যাঁর পরাসত্তা, কেবলমাত্র জ্ঞানের দ্বারা প্রতিপাদিতা হন, তিনিই ললিতা। যিনি সকল হৃদয়ে ‘আত্মা’ রূপে বিরাজমানা, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মরূপে যিনি নিয়ত ক্রিয়াশীল, সেই সর্বভূতান্তরাত্মা, দেদীপ্যমান পরমাত্মাই, মাতা ললিতা। এই কৃপাময়ী ললিতাই দেবগণের চিদাগ্নিকুণ্ড থেকে আবির্ভূত হয়েছেন, কামেশ্বরীরূপে, দেবগণের অনন্যশরণাগতি, আত্মনিবেদনের জন্য, দেবকার্য উদ্ধারের নিমিত্ত। তিনি আপন অভিন্ন-রূপ কামেশ্বর শিবের সঙ্গে মিলিত হয়ে অসুর বিনাশ করেছেন। দেবগণকে পুনরায় উজ্জীবিত করেছেন, তাঁদের বিপন্মুক্ত করে সকল বাঞ্ছা পূর্ণ করেছেন।

“দেব-দানবের সমুদ্র-মন্থনের পর দেবী ললিতাই শ্রীবিষ্ণুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে অতি-অদ্ভুত ‘মোহিনী’ অবতার ধারণ করেছিলেন। পিনাকপাণি মহাদেব, যিনি মদনকে পরাস্ত করেছিলেন, তিনিও মোহিনী অবতারে মুগ্ধ হয়ে মিলনপিপাসু হয়েছিলেন। তাঁদের মিলনে অসুরমর্দক ধর্মশস্ত ‘আইয়াপ্পা’ জন্ম নিয়েছিলেন।”

দেবর্ষি হয়গ্রীবের কথনে বিস্ময়াবিষ্ট অগস্ত্যের মনে আরো জানার কৌতূহল জন্ম নিতে লাগল। তিনি দেবর্ষিকে বিস্তারিত বর্ণনার জন্য অনুরোধ করলেন। দেবর্ষি বললেন, “তবে ‘দেবরাজ ইন্দ্রের প্রতি দুর্বাসার অভিশাপ’ থেকে তোমায় বর্ণনা করে শোনাব। কীভাবে সর্বৈশ্বর্যময় স্বর্গরাজ্যের অধিপতি হয়ে ইন্দ্র মোহান্ধ ও অহংকারপঙ্কে নিমজ্জ হয়েছিলেন, এবং মহামায়ার ইচ্ছায় তার ফলে কেমন ভাবে স্বর্গরাজ্য অন্ধকার নগরীতে পরিণত হয়েছিল, তার সকলই আমি তোমার কাছে বর্ণনা করব।”

Subhadeep Saha

Subhadeep Saha is a Kolkata based freelance writer and commentator. He is an associate of The Saborno Sangrahalay - an evolving India studies resource centre in Kolkata.

0 Reviews

Related post