ললিতা-উপাখ্যান—ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন–২

 ললিতা-উপাখ্যান—ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন–২

ভূমিকা- দ্বিতীয় পর্ব

শিবঃ শক্ত্যা যুক্তো যদি ভবতি শক্তঃ প্রভবিতুং

ন চেদেবং দেবো ন খলু কুশলঃ স্পন্দিতুমপি।

অতস্ত্বামারাধ্যাং হরিহরবিরিঞ্চাদিভিরপি

প্রণন্তুং স্তোতুং বা কথমকৃতপুণ্যঃ প্রভবতি।।

আনন্দলহরী, আদি শংকরাচার্য

শিব যদি শক্তিযুক্ত না হন, তবে শিবের স্পন্দনেও সামর্থ্য থাকে না। ই-কার শক্তিস্বরূপা, শিব শব্দে ই-কার যুক্ত না হলে তিনি ‘শব’ হন, শবের স্পন্দন ঘটে না। শিব-শক্তির সম্মিলনেই জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় ঘটে। এই শক্তি প্রণবস্বরূপা (অ-হরি, উ-হর, ম-বিরিঞ্চি/ব্রহ্মা), আবার ইচ্ছা-জ্ঞান-ক্রিয়াশক্তির সম্মিলনে ভদ্রা-শান্তাশক্তির বিকাশ এই ললিতা ত্রিপুরসুন্দরী। আমি পুণ্যহীন, এহেন শক্তির স্তুতি করি, এমন সাধ্য কোথায়!

     ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে ষোড়শী বা ললিতার একটি ছোট্ট কিন্তু সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়।

রক্তবর্ণা ত্রিনয়না ভালে সুধাকর,

চারিহাতে শোভে পাশাঙ্কুশ ধনুঃশর।

বিধি বিষ্ণু ঈশ্বর মহেশ রুদ্র পঞ্চ,

পঞ্চপ্রেত নিয়মিত বসিবার মঞ্চ।

শ্রীশ্রীমায়ের হাতে পাশ, অঙ্কুশ, ধনুক ও তীর থাকে, তাঁর তনু রক্তবর্ণ, তাঁর তিনটি নয়ন চন্দ্র-সূর্য-অগ্নির দ্যোতক। ললিতাসহস্রনামে বলা হচ্ছে,

“উদ্যদ্-ভানু-সহস্রাভা চতুর্বাহু-সমন্বিতা।

রাগস্বরূপ-পাশাঢ্যা ক্রোধকারাঙ্কুশোজ্জ্বলা।।

মনোরূপ-ইক্ষু-কোদণ্ডা পঞ্চ-তন্মাত্র-সায়কা।

নিজারুণ-প্রভাপুর-মজ্জদ্-ব্রহ্মাণ্ডমণ্ডলা।।”

দেবী সহস্র উদিত সূর্যের আভাযুক্ত, চতুর্ভুজা। তাঁর বামহস্তে পাশ রয়েছে, সেই পাশ রাগ অর্থাৎ প্রেমের দ্যোতক। পাশ আক্ষরিক অর্থে বন্ধনের প্রতীক, কিন্তু এই বন্ধন প্রেমের, ভালোবাসার। দেবী জগতকে রাগপাশে, ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। দেবীর ডানহাতে রয়েছে, ক্রোধে উজ্জ্বল অঙ্কুশ, যে ক্রোধ শত্রুর ভীতিবর্ধন করে, কিন্তু দেবী তা নিয়ন্ত্রণ করেছেন। একইভাবে, দেবীর নিম্ন বামভুজে রয়েছে, মনোরূপ ইক্ষু কোদণ্ড, অর্থাৎ, আখগাছের ধনুক যা মনের প্রতীক। আর নিম্ন দক্ষিণভুজে রয়েছে পঞ্চ-তন্মাত্র-সায়ক, অর্থাৎ, পাঁচটি বাণ যা রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ প্রভৃতি পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ানুভূতির প্রতীক।

ললিতাসহস্রনামেও দেবীকে ‘পঞ্চপ্রেত-আসন-আসীনা’ বা ‘পঞ্চব্রহ্মাসনস্থিতা’ বলা হচ্ছে। এই পঞ্চপ্রেত কারা? সেটা জানার আগে দেবীর যোগপীঠ সম্বন্ধে একটু বর্ণনা করে রাখা দরকার। শ্রী দেবী যে নগরে নিবাস করেন, সেই নগরের নাম ‘শ্রীনগর’। সহস্রনামে বলা হচ্ছে, ‘শ্রীমন্নগরনায়িকা’। ‘শ্রীললিতাত্রিপুরসুন্দরীহৃদয়’ স্তোত্রে এই শ্রীনগরের একটি সুন্দর বর্ণনা আছে। সেখানে প্রথমেই শ্রীচক্র বা ললিতা-চক্রের স্তুতি করা হয়েছে, “ক্রমান্বয়ে ১. বিন্দু, ২. ত্রিকোণ, ৩. অষ্টকোণ, ৪. অন্তর্দশার (১০টি ত্রিকোণ), ৫. বহির্দশার, ৬. চতুর্দশার (১৪টি ত্রিকোণ), ৭. অষ্টদল পদ্ম, ৮. ষোড়শদল পদ্ম, ৯. ত্রিবৃত্ত ও ভূপুর (শ্রীচক্রের প্রবেশ দ্বার) সহ শ্রীচক্রকে প্রণাম করি, যা ভক্তকে বাঞ্ছিত ফল দান করে।” এই নটি চক্রের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে শ্রীযন্ত্র, তন্ত্রশাস্ত্রের সবচেয়ে জটিল, সর্বোত্তম এবং সুন্দরতম যন্ত্র। কথিত আছে, এই যন্ত্রে সর্বদেবদেবীর বাস। প্রতিটি চক্রের পৃথক নাম আছে এবং পৃথক পৃথক আবরণ দেবতা রয়েছে। আমরা কল্পনা করি ভূপুর থেকে বিন্দু পর্যন্ত ক্রমে।

  • ১. ভূপুর- এই চক্রের নাম ত্রৈলোক্যমোহন চক্র। চতুরস্র ভূপুরের দশ কোণে ও আটটি বাহুতে অণিমাদি দশসিদ্ধি আর ব্রাহ্মী-মাহেশ্বরী প্রমুখ অষ্টশক্তির পূজা হয়।
  • ২. ষোড়শদল পদ্ম- এই চক্রের নাম সর্বাশাপরিপূরক চক্র। এই পদ্মের ষোলোটি দলে ষোলোজন আকর্ষিণী কলাবিদ্যার পূজা হয়।
  • ৩. অষ্টদল পদ্ম- এই চক্রের নাম সর্বসংক্ষোভণ চক্র। এই পদ্মের আটটি দলে আটজন অনঙ্গবিদ্যার পূজা হয়।
  • ৪. চতুর্দশার- এই চক্রের নাম সর্বসৌভাগ্যদায়ক চক্র। এই চক্রের চোদ্দটি ত্রিভুজে সর্বসংক্ষোভিণী প্রমুখ চতুর্দশ শক্তির পূজা হয়।
  • ৫. বহির্দশার- এই চক্রের নাম সর্বার্থসাধক চক্র। এখানে সর্বসিদ্ধিপ্রদা প্রমুখ দশজন দেবীর পূজা হয়।
  • ৬. অন্তর্দশার- এই চক্রের নাম সর্বরক্ষাকর চক্র। এখানেও সর্বজ্ঞা প্রমুখ দশজন দেবীর পূজা হয়।
  • ৭. অষ্টকোণ বা অষ্টার- এই চক্রের নাম সর্বরোগহর চক্র। এই চক্রে বশিনী প্রমুখ আটজন বাগ্‌দেবতার পূজা হয়। দুটি অধোমুখ ত্রিকোণ এবং একটি ঊর্ধ্বমুখ ত্রিকোণ মিলিত হয়ে যথাক্রমে আটটি ত্রিভুজ বা অষ্টার, তিনটি চতুর্ভুজ আর একটি অধোমুখ ত্রিকোণ তৈরি করেছে। তিনটি চতুর্ভুজে দিব্য, সিদ্ধ ও মানব গুরুদের পূজা বিধেয়। আর অধোমুখ ত্রিকোণের তিনদিকে পাঁচজন করে মোট পনেরোজন নিত্যাদেবী থাকেন, এঁরা তিথির প্রতীক, আর থাকে পাশাঙ্কুশাদি চারজন আয়ুধ দেবতা।
  • ৮. ত্রিকোণ- এই চক্রের নাম সর্বসিদ্ধিপ্রদ চক্র। এই চক্রের অধোমুখ ত্রিকোণের তিন কোণে মহাকামেশ্বরী, মহাবজ্রেশ্বরী, মহাভগমালিনী এই তিন দেবীর পূজা হয়।
  • ৯. বিন্দু- শ্রীযন্ত্রের সর্বোচ্চ স্থান এই বিন্দু। এই চক্রের নাম সর্বানন্দময় চক্র। এই বিন্দুতেই মহাশক্তি সর্বদেবতার অধীশ্বরী দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী অধিষ্ঠান করেন। সহস্রনামে দেবীকে বলা হয়েছে, ‘বিন্দুমণ্ডলবাসিনী’। শিবশক্তির মিলিত রূপ এই বিন্দু। এখানেই কামেশ্বরের কোলে বসে আছেন কামেশ্বরী।

আপাতদৃষ্টিতে বিন্দু হলেও সেই বিন্দুতেই রয়েছে সিন্ধুর খোঁজ। ফকির লালন সাঁইয়ের একটি গানে পাই,

বিন্দু মাঝে সিন্ধুবারি

মাঝখানে তার স্বর্ণগিরি

অধরচাঁদের স্বর্গপুরী

সেহি তো তিল প্রমাণ জাগায়।।

এই বিন্দুর মাঝেই দেবীর সেই ‘শ্রীনগর’ কল্পিত হয়। শ্রীনগরে চুয়াল্লিশটি অংশ রয়েছে।

  • ১. অমৃতাম্ভোনিধি- সুধাসাগর বলা হয় একে। সমুদ্র বা সিন্ধু যাই বলি।
  • ২. রত্নদ্বীপ- কারণসমুদ্রের মধ্যভাগে অবস্থিত এক মণিময় দ্বীপ।
  • ৩. নানাবৃক্ষমহোদ্যান- দ্বীপের চতুর্দিকে নানান গাছের বাগান।
  • ৪. কল্পবাটিকা ৫. সন্তানবাটিকা ৬. হরিচন্দনবাটিকা ৭. মন্দারবাটিকা ৮. পারিজাতবাটিকা ৯. কদম্ববাটিকা, এগুলিও সব বিভিন্ন গাছের পৃথক পৃথক বাগান।
  • ১০. পুষ্পরাগ ১১. পদ্মরাগ ১২. গোমেদ, ১৩. বজ্র ১৪. বৈদুর্য ১৫. ইন্দ্রনীল ১৬. মুক্তা ১৭. মরকত ১৮. বিদ্রুম ১৯. মাণিক্য, এগুলি এক-একটি রত্নপ্রাকার বা রত্নের প্রাচীর।
  • ২০. মাণিক্যমণ্ডপ ২১. সহস্রস্তম্ভ মণ্ডপ, দুটি স্তরে হাজারটি স্তম্ভযুক্ত মাণিক্য বা চুনীর মণ্ডপ রয়েছে।
  • তার তিনদিকে ২২. অমৃতবাপিকা ২৩. আনন্দবাপিকা ২৪. বিমর্শবাপিকা নামে তিনটি জলাশয় রয়েছে। যেখানে ২৪. বালাতপোদ্‌গার ও ২৫. চন্দ্রিকোদ্‌গার, অর্থাৎ, উদিত সূর্য ও চন্দ্রের কিরণ একত্রে সবসময় বিকিরিত হচ্ছে।
  • ২৬. মহাশৃঙ্গারপরিঘা- একটি বিশাল পরিখা কাটা রয়েছে। যার মধ্যে ২৭. মহাপদ্মাটবী, অর্থাৎ, মহাপদ্মের বন সৃষ্টি হয়েছে। পরিখা পার করলেই, ২৮. চিন্তামণিময় গৃহরাজ অর্থাৎ, চিন্তামণি রত্নে রচিত এক বিশাল গৃহ, যার চারদিকে চারটি সুদৃশ্য দরজা, এক-একটি দরজা এক-একটি আম্নায়ের প্রতীক, ২৯. পূর্বাম্নায়ময় পূর্বদ্বার ৩০. দক্ষিণাম্নায়ময় দক্ষিণদ্বার ৩১. পশ্চিমাম্নায়ময় পশ্চিমদ্বার ৩২. উত্তরাম্নায়ময় উত্তরদ্বার।
  • ৩৩. রত্নপ্রদীপবলয়- সেই গৃহে প্রবেশ করলেই রত্নময় দীপরাশির বলয় দেখা যাবে।
  • ৩৪. মণিময়মহাসিংহাসন- বলয় পেরোলে দেখা যাবে বিশাল এক মণিময় সিংহাসন। সেই সিংহাসনই আসলে পঞ্চব্রহ্মাসন বা পঞ্চপ্রেতাসন।
  • ৩৫. ব্রহ্মময়-একমঞ্চপাদ- সিংহাসনের একটি পদ বা পায়া হচ্ছেন ব্রহ্মা।
  • ৩৬. বিষ্ণুময়-একমঞ্চপাদ- সিংহাসনের আরেকটি পদ বা পায়া হচ্ছেন বিষ্ণু।
  • ৩৭. রুদ্রময়-একমঞ্চপাদ- সিংহাসনের আরেকটি পদ বা পায়া হচ্ছেন রুদ্র।
  • ৩৮. ঈশ্বরময়-একমঞ্চপাদ- সিংহাসনের অবশিষ্ট পদ বা পায়া হচ্ছেন সগুণ ঈশ্বর।
  • ৩৯. সদাশিব-এক-মঞ্চ-ফলক- সিংহাসনের ফলক বা মূল আধারটি হচ্ছেন সদাশিব। এই পাঁচজনকে নিয়েই রচিত হল পঞ্চপ্রেতের আসন বা সিংহাসন। এই সিংহাসন সজ্জিত আছে, বিছানা, চাদর, পর্দা প্রভৃতি দ্বারা।
  • ৪০. হংসতুলিকাতল্প- হাঁসের মতো সাদা ও নরম গদি।
  • ৪১. হংসতুলিকামহোপধান ৪২. কৌসুম্ভ আস্তরণ ৪৩. মহাবিতান ৪৪. মহামায়া যবনিকা। গদির উপর চাদর ও কুসুমের আস্তরণ দেওয়া। আর উপরে চাঁদোয়া এবং সিংহাসনের চারদিকে সুদৃশ্য পর্দা দ্বারা শোভিত। মহামায়া যবনিকা শব্দটি এখানে খুবই অর্থবহ। মহামায়া এই মায়ার পর্দা দিয়ে আমাদের চৈতন্যকে আবৃত করে রাখেন বলেই আমরা এই সুধাসাগর সাঁতরে রত্নদ্বীপে প্রবেশ করতে পারি না।

শ্রীনগরস্থিত চিন্তামণিগৃহে এই পঞ্চব্রহ্মময় সিংহাসনেই বসে আছেন কামেশ্বরের কোলে ভগবতী রাজরাজেশ্বরী ত্রিপুরাসুন্দরী কামেশ্বরী ললিতা মহামায়ী। সম্পুর্ণটিই সাধকের ভাবরাজ্যে, সমান্তরাল জগতের অংশ।

এরপর আমরা পড়ব জগজ্জননীর লীলাময় অপূর্ব পৌরাণিক কাহিনী। পরিশেষে একটা সাবধানবাণী শোনাব, এই শ্রীযন্ত্র অতি জটিল জ্যামিতিক কারুকাজ, নির্মাণে সামান্য বিকার হলেই যন্ত্রের মান্যতা থাকে না। আর ধাপে ধাপে প্রতিটি চক্র কল্পনা করা ও সাধনা জটিলতম বিষয়। অধিকারী সাধক সাধনার অত্যুচ্চ স্থানে না পৌঁছালে কল্পনার সামান্য আভাসও পাওয়া যায় না। অধুনা, কিছু ব্যবসায়ী জ্যোতিষী অর্থের বিনিময়ে ভুলভাল শ্রীযন্ত্র বিক্রি করেন এবং গৃহস্থকে প্ররোচিত করেন ক্রয় করে ঘরে রাখার জন্য, তাতে নাকি গ্রহদোষ কাটে, অর্থাগম হয়, ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে অনধিকারীর পূজা করা শ্রীযন্ত্র বা ত্রুটিপূর্ণ শ্রীযন্ত্রের মতো দেখতে একটা পিরামিড গোছের কিছু তা ঘরে রাখলে, শো-পিস হিসেবে কাজ করতে পারে, কিন্তু অর্থদণ্ড ছাড়া জাগতিক বা অলৌকিক কোনও কার্যই সিদ্ধ হয় না। অতএব, সাধু সাবধান!

Subhadeep Saha

Subhadeep Saha is a Kolkata based freelance writer and commentator. He is an associate of The Saborno Sangrahalay - an evolving India studies resource centre in Kolkata.

0 Reviews

Related post