ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ১৩
শরজ্জ্যোৎস্নাশুদ্ধাং শশিয়ুতজটাজূটমকুটাং
বরত্রাসত্রাণস্ফটিকঘটিকাপুস্তককরাম্।
সকৃন্নত্বা নত্বা কথমিব সতাং সন্নিদধতে
মধুক্ষীরদ্রাক্ষামধুরিমধুরীণাঃ ভণিতয়ঃ
— সৌন্দর্যলহরী, আদি শংকরাচার্য
শ্রীচক্র-রথে দেবী পঞ্চবিংশতি নাম-পারায়ণে দেবগণ কর্তৃক বন্দিতা হলেন। সুন্দরী, চক্রনাথা, সম্রাজ্ঞী, চক্রিণী, চক্রেশ্বরী, মহাদেবী, কামেশী, পরমেশ্বরী, কামরাজপ্রিয়া, কামকোটিগা, চক্রবর্তিনী, মহাবিদ্যা, শিবা, অনঙ্গবল্লভা, সর্বপাটলা, কুলনাথা, আম্নায়-নাথা, সর্বাম্নায়নিবাসিনী ও শৃঙ্গারনায়িকা। যিনি এই নাম পারায়ণ করেন, তিনি অণিমাদি অষ্টসিদ্ধি, পরম সৌভাগ্য ও যশের অধিকারী হন।
শ্রীচক্র-রথ নয়টি পর্ব বা নয়টি চক্রের সমাহার। পূর্বেও আলোচনা হয়েছে এই বিষয়ে। পুনরায় বিস্তারিত আলোচনা করা যাক। এই নয়টি চক্রে বিভিন্ন দেবদেবী উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেক চক্রের যোগিনী দেবী, চক্রেশ্বরী দেবী, সিদ্ধি ও মুদ্রা দেবী ভিন্ন। প্রতি চক্রে চক্রেশ্বরীর দক্ষিণে সিদ্ধি ও বামে মুদ্রা দেবী অবস্থান করেন। আবার প্রথম চক্রে অর্থাৎ ভূপুরে সমস্ত সিদ্ধি ও মুদ্রা দেবীই বাস করেন। প্রত্যেক চক্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও দেবীই স্বয়ং সর্বচক্রের অধিশ্বরী।
১. ভূপুর- এই চক্রের নাম ত্রৈলোক্যমোহন চক্র। তিনটি চতুরস্র ভূপুরের প্রথমটিতে দশজন সিদ্ধি দেবী, দ্বিতীয়টিতে ব্রাহ্ম্যাদি অষ্টশক্তি এবং তৃতীয়টিতে দশজন মুদ্রাদেবী রয়েছেন। সিদ্ধিদেবীরা হলেন অণিমা, লঘিমা, মহিমা, ঈশিতা, বশিতা, প্রাকাম্য, ভুক্তি, ইচ্ছা, প্রাপ্তি ও সর্বকামসিদ্ধি। সিদ্ধিদেবীগণ সকলেই চতুর্ভুজা, জপাকুসুমপ্রখ্যা, চিন্তামণি, কপাল, ত্রিশূল এবং সিদ্ধি-অঞ্জন ধারণ করে আ
ছেন। এছাড়াও রয়েছেন ব্রাহ্মী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বারাহী, মাহেন্দ্রী, চামুণ্ডা এবং মহালক্ষ্মী তথা অষ্টশক্তি। এঁরা ব্রহ্মাদি দেবগণের শক্তি-প্রতিভূ। আর মহালক্ষ্মী উৎপল-কপালধারিণী স্বয়ং শোণবর্ণা মহাশক্তি। মুদ্রাশক্তিরা হলেন সর্বসংক্ষোভিণী, সর্ববিদ্রাবিণী, সর্বাকর্ষিণী, সর্ববশংকরী, সর্বোন্মাদিনী, সর্বমহাঙ্কুশা, সর্বখেচরী, সর্ববীজা, সর্বযোনি ও সর্বত্রিখণ্ডা। এঁরাও সকলেই চতুর্ভুজা, পীতাম্বরী, দাড়িম্ববর্ণা, দুই হাতে পাশাঙ্কুশ ও অপর দুই হাতে বরাভয় ধারণ করে আছেন। এই চক্রের চক্রেশ্বরী ত্রিপুরা, যোগিনীদেবতা প্রকটযোগিনী, সিদ্ধিদেবী অণিমা, মুদ্রাদেবী সর্বসংক্ষোভিণী।
২. ষোড়শদল পদ্ম- এই চক্রের নাম সর্বাশাপরিপূরক চক্র। এই পদ্মের ষোলোটি দলে ষোলোজন আকর্ষিণী কলাবিদ্যা রয়েছেন। কামাকর্ষিণী, বুদ্ধ্যাকর্ষিণী, অহংকারাকর্ষিণী, শব্দাকর্ষিণী, স্পর্শাকর্ষিণী, রূপাকর্ষিণী, রসাকর্ষিণী, গন্ধ্যাকর্ষিণী, চিত্তাকর্ষিণী, ধৈর্যাকর্ষিণী, স্মৃত্যাকর্ষিণী, নামাকর্ষিণী, বীজাকর্ষিণী, আত্মাকর্ষিণী, অমৃতাকর্ষিণী, শরীরাকর্ষিণী প্রভৃতি। এই চক্রের চক্রেশ্বরী ত্রিপুরেশী, যোগিনীদেবতা গুপ্তযোগিনী, সিদ্ধিদেবী লঘিমা, মুদ্রাদেবী সর্ববিদ্রাবিণী।
৩. অষ্টদল পদ্ম- এই চক্রের নাম সর্বসংক্ষোভণ চক্র। এই পদ্মের আটটি দলে আটজন অনঙ্গবিদ্যা রয়েছেন। অনঙ্গকুসুমা, অনঙ্গমেখলা, অনঙ্গমদনা, অনঙ্গমদনাতুরা, অনঙ্গরেখা, অনঙ্গবেগিনী, অনঙ্গাঙ্কুশা ও অনঙ্গমালিনী। এই চক্রের চক্রেশ্বরী ত্রিপুরসুন্দরী, যোগিনীদেবতা গুপ্ততরযোগিনী, সিদ্ধিদেবী মহিমা, মুদ্রাদেবী সর্বাকর্ষিণী।
৪. চতুর্দশার- এই চক্রের নাম সর্বসৌভাগ্যদায়ক চক্র। এই চক্রের চোদ্দটি ত্রিভুজে সর্বসংক্ষোভিণী প্রমুখ ষোড়শ শক্তি রয়েছেন। সর্বসংক্ষোভিণী, সর্ববিদ্রাবিণী, সর্বাকর্ষিণী, সর্বাহ্লাদিনী, সর্বসংমোহিনী, সর্বস্তম্ভিনী, সর্বজৃম্ভণী, সর্ববশংকরী, সর্বরঞ্জিনী, সর্বোন্মাদনী, সর্বার্থসাধিনী, সর্বসম্পত্তিপূরণী, সর্বমন্ত্রময়ী, সর্বদ্বন্দ্বক্ষয়ঙ্করী প্রভৃতি। এই চক্রের চক্রেশ্বরী ত্রিপুরবাসিনী, যোগিনীদেবতা সম্প্রদায়যোগিনী, সিদ্ধিদেবী ঈশিত্ব, মুদ্রাদেবী সর্বাকর্ষিণী।
৫. বহির্দশার- এই চক্রের নাম সর্বার্থসাধক চক্র। এই দশটি ত্রিভুজে সর্বসিদ্ধিপ্রদা প্রমুখ দশজন দেবী রয়েছেন। সর্বসিদ্ধিপ্রদা, সর্বসম্পৎপ্রদা, সর্বপ্রিয়ংকরী, সর্বমঙ্গলকারিণী, সর্বকামপ্রদা, সর্বদুঃখবিমোচিনী, সর্বমৃত্যুপ্রশমনী, সর্ববিঘ্ননিবারিণী, সর্বাঙ্গসুন্দরী, সর্বসৌভাগ্যদায়িনী প্রভৃতি। এই চক্রের চক্রেশ্বরী ত্রিপুরাশ্রী, যোগিনীদেবতা কুলোত্তীর্ণযোগিনী, সিদ্ধিদেবী বশিত্ব, মুদ্রাদেবী সর্বোন্মাদিনী।
৬. অন্তর্দশার- এই চক্রের নাম সর্বরক্ষাকর চক্র। এখানেও সর্বজ্ঞা প্রমুখ দশজন দেবীর পূজা হয়। সর্বজ্ঞা, সর্বশক্তিময়ী, সর্বৈশ্বর্যপ্রদা, সর্বজ্ঞানময়ী, সর্বব্যাধিবিনাশিনী, সর্বাধারস্বরূপা, সর্বপাপহরা, সর্বানন্দময়ী, সর্বরক্ষাস্বরূপিণী, সর্বেপ্সিতফলপ্রদা প্রভৃতি। এই চক্রের চক্রেশ্বরী ত্রিপুরামালিনী, যোগিনীদেবতা নিগর্ভযোগিনী, সিদ্ধিদেবী প্রাকাম্য, মুদ্রাদেবী সর্বমহাঙ্কুশা।
৭. অষ্টকোণ বা অষ্টার- এই চক্রের নাম সর্বরোগহর চক্র। এই চক্রে বশিনী প্রমুখ আটজন বাগ্দেবতা রয়েছেন। বশিনী, কামেশ্বরী, মোদিনী, বিমলা, অরুণা, জয়িনী, সর্বেশ্বরী ও কৌলিনী। দুটি অধোমুখ ত্রিকোণ এবং একটি ঊর্ধ্বমুখ ত্রিকোণ মিলিত হয়ে যথাক্রমে আটটি ত্রিভুজ বা অষ্টার, তিনটি চতুর্ভুজ আর একটি অধোমুখ ত্রিকোণ তৈরি করেছে। তিনটি চতুর্ভুজে দিব্য, সিদ্ধ ও মানব গুরুবর্গ থাকেন। আর অধোমুখ ত্রিকোণের তিনদিকে পাঁচজন করে মোট পনেরোজন তিথি-নিত্যাদেবী থাকেন, কামেশী, ভগমালিনী, নিত্যক্লিন্না, ভেরুণ্ডা, বহ্নিবাসিনী, মহাবজ্রেশ্বরী, শিবদূতী, ত্বরিতা, কুলসুন্দরী, নিত্যা, নীলপতাকা, বিজয়া, সর্বমঙ্গলা, জ্বালামালিনী, চিত্রা প্রভৃতি, এঁরা তিথির প্রতীক। আর থাকেন পাশাঙ্কুশাদি চারজন আয়ুধ দেবতা।
এই চক্রের চক্রেশ্বরী ত্রিপুরাসিদ্ধা, যোগিনীদেবতা রহস্যযোগিনী, সিদ্ধিদেবী ভুক্তি, মুদ্রাদেবী সর্বখেচরী।
৮. ত্রিকোণ- এই চক্রের নাম সর্বসিদ্ধিপ্রদ চক্র। এই চক্রের অধোমুখ ত্রিকোণের তিন কোণে মহাকামেশ্বরী, মহাবজ্রেশ্বরী, মহাভগমালিনী ও মধ্যে মহাত্রিপুরসুন্দরী এই চার দেবী রয়েছেন। এই চক্রের চক্রেশ্বরী ত্রিপুরাম্বা, যোগিনীদেবতা অতির
হস্যযোগিনী, সিদ্ধিদেবী ইচ্ছা, মুদ্রাদেবী সর্ববীজ।
৯. বিন্দু- শ্রীযন্ত্রের সর্বোচ্চ স্থান এই বিন্দু। এই চক্রের নাম সর্বানন্দময় চক্র। এই বিন্দুতেই
মহাশক্তি সর্বদেবতার অধীশ্বরী দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী অধিষ্ঠান করেন। সহস্রনামে দেবীকে বলা হয়েছে, ‘বিন্দুমণ্ডলবাসিনী’। শিবশক্তির মিলিত রূপ এই বিন্দু। এখানেই কামেশ্বরের কোলে বসে আছেন কামেশ্বরী।
এই চক্রের চক্রেশ্বরী মহাত্রিপুরসুন্দরী, যোগিনীদেবতা পরাপরাতিরহস্যযোগিনী, সিদ্ধিদেবী প্রাপ্তি, মুদ্রাদেবী সর্বযোনি।