ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ১২

দেবী ললিতা, দেবী মাতঙ্গী ও দেবী বারাহী

শরজ্জ্যোৎস্নাশুদ্ধাং শশিয়ুতজটাজূটমকুটাং

বরত্রাসত্রাণস্ফটিকঘটিকাপুস্তককরাম্।

সকৃন্নত্বা নত্বা কথমিব সতাং সন্নিদধতে

মধুক্ষীরদ্রাক্ষামধুরিমধুরীণাঃ ভণিতয়ঃ

আনন্দলহরী, শ্রীশংকরাচার্য

নারদ বললেন, “হে দেবী আপনি পরা-প্রকৃতি, দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন করতে, ভোগ-মোক্ষ প্রদান করতে ললিতা ত্রিপুরসুন্দরীর রূপ প্রকাশ করেছেন। হে পরমেশ্বরী, ভণ্ডাসুরের প্রকোপে ত্রিজগত আজ অত্যাচারিত। এই দুর্ধর্ষ দৈত্যকে কোনও সুর-নর পরাস্ত করতে পারবে না। ভণ্ড কেবল আপনার হাতেই পরাজিত হবে। হে কল্যাণী, কৃপা করে অশুভশক্তিকে কলন করে শুভশক্তির প্রকাশ করুন। সমস্ত দেবগণ আপনারই সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন, তাঁদের কৃপাকটাক্ষ দান করুন।”

     নারদ-বচনে দেবী ললিতা প্রসন্ন হয়ে যুদ্ধ-বিজয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। মর্দলাদি নানাবিধ রণধ্বনি বেজে উঠল চতুর্দিকে। দেবীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে শক্তি-সেনা নিষ্কৃত ও আবির্ভূত হতে লাগল।

১. দেবী সম্পৎকরী: দেবী ললিতার অঙ্কুশ থেকে নির্গত হলেন দেবী সম্পৎকরী। তরুণ সূর্যের ন্যায় আভা তাঁর। কোটি গজ ও রথ দ্বারা বেষ্টিত তিনি উদ্দণ্ড-রণ-রসিকা। তিনি ‘রণ-কোলাহল’ নামক একটি মত্ত হস্তীর পৃষ্ঠে আরোহণ করেছেন। তাঁর বুকে পীন-পয়োধরের ন্যায় কণ্টক বর্তমান। তাঁর হাতে খড়্গ বিদ্যমান। হুঙ্কারসহ অতিঘোর সেনাদল তাঁকে অনুসরণ করছে। পর্বতের সমান গজগণ দেবীর চতুর্দিকে বেষ্টিত। গজসৈন্যের ঈশ্বরী তিনি, দেবী ললিতার অঙ্কুশের প্রতিভূ, যা মনকরীকে বশ করে।

২. দেবী অশ্বারুঢ়া: দেবী ললিতার পাশ থেকে উৎপন্ন হলেন দেবী অশ্বারুঢ়া। নানা দেশের নানা জাতির অত্যন্ত বেগবান ও স্থিরচিত্ত অশ্ব দ্বারা দেবী বেষ্টিত ছিলেন। অশ্বদের মধ্যে স্বস্তিকাদি নানাবিধ শুভচিহ্ন অঙ্কিত ছিল। তরুণসূর্যসমকান্তি দেবী অশ্বারুঢ়া স্বয়ং ‘অপরাজিত’ নামের একটি তেজস্বী অশ্বে আরোহণ করেছিলেন। দেবী চারিহস্তে পাশ, অঙ্কুশ, বেত্র ও অশ্বের বল্গা ধারণ করেছেন। অশ্বগণের হ্রেষা ও ক্ষুরের শব্দে মহানাদ উৎপন্ন হয়েছিল। হয়সৈন্যের নিয়ন্তা তিনি, দেবী ললিতার পাশের প্রতিভূ, যা হয়সম দুর্বার ইন্দ্রিয়সকলকে দমন করে।

৩. দেবী দণ্ডনাথা: দেবী ললিতার অহংকার থেকে উৎপন্ন হলেন দেবী বার্তালী বা বারাহী। তিনিই দেবী ললিতার প্রধানা দণ্ডনায়িকা বা বলাধ্যক্ষা। তাঁর বাহিনী মণিমণ্ডিত বহুতর শ্বেতছত্র, তালবৃন্ত ধারণ করেছিল। প্রচণ্ড শূলহস্ত ভৈরবগণ তাঁর সেনাবাহিনীতে নিয়োজিত ছিল। সহস্র-মহিষযুক্ত কিরিচক্র নামক রথ থেকে বরাহবদনা দেবী বারাহী ‘বজ্রঘোষ’ নামক মহাসিংহে আরোহণ করে  সৈন্যসহ প্রবল হুঙ্কারে ও রোষধ্বনিতে দিঙ্‌মণ্ডল বিদীর্ণ করে রণযাত্রা করলেন। তিনি অষ্টভুজা, শঙ্খ-চক্র, খড়্গ-খেটক, মুষল-হল ও বরাভয় ধারণ করেছেন। ইনি দেবী ললিতার আজ্ঞাচক্রের প্রতিভূ। পঞ্চমী, দণ্ডনাথা, সংকেতা, সময়েশ্বরী, সময়-সংকেতা, বারাহী, পৌত্রিণী, বার্তালি, মহাসেনা, আজ্ঞা, চক্রেশ্বরী, অরিঘ্নী প্রভৃতি দ্বাদশ নাম-পারায়ণে তিনি সন্তুষ্টা হন।

৪. দেবী মন্ত্রনাথা: দেবী ললিতার বুদ্ধি থেকে উৎপন্ন হলেন দেবী মাতঙ্গী। ইনি দেবীর ললিতার প্রধানা মন্ত্রী। ইনি শ্যামা বা শ্যামলা নামেও পূজিতা হন। ইনি বীণাবাদিনী। শ্যামলার শক্তিসেনা জগতকে বীণা-বেণু-মৃদঙ্গবাদনে, নৃত্যে, মত্ত-কোকিলকণ্ঠে গান গেয়ে হর্ষ প্রদান করেন। এঁরা কেউ কেউ ময়ূরবাহনা, কেউ কেউ হংসবাহনা, কেউ কেউ কোকিলবাহনা, আবার কেউ বা নকুলবাহনা। কদম্বের মধু পান করে এঁরা সকলেই মদমত্তা ছিলেন। মন্ত্রনাথাকে সম্মুখে রেখে এঁরা এলেন। মন্ত্রিণী, সচিবেশী, প্রধানেশী, শুকপ্রিয়া, বীণাবতী, বৈণিকী, মুদ্রিণী, প্রিয়কপ্রিয়া, নীপপ্রিয়া, কদম্বেশী, কদম্ববনবাসিনী, সদামদা প্রভৃতি ষোড়শ নামে তাঁকে বন্দনা করলেন দেবগণ। ইনি পাশাঙ্কুশ, বাণ-চাপ, শুকপক্ষী ও বীণা ধারণ করেন। দেবী শ্যামলা গেয়-চক্রে আরুঢ়া। ইনি দেবী ললিতার জিহ্বা বা বাকের প্রতিভূ।    

শ্রীচক্ররথারুঢ়া দেবী রাজনায়িকা ললিতা পরমেশ্বরী হস্তে জ্বলন্ত কৃশানুর ন্যায় অঙ্কুশ, সর্পের সমান পাশ, ইক্ষুধনুক ও পঞ্চ-পুষ্পবাণ ধারণ করে আছেন। কোটিসূর্যের ঊর্জা ও কোটিচন্দ্রের কান্তি তাঁর উপস্থিতির মাধ্যমে প্রতিভাত হচ্ছিল। বহুযোজন উচ্চ তাঁর রথের ধ্বজা। অনন্ত দেবগণ কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁর বন্দনা ও সেবা করছেন।

দেবী অশ্বারুঢ়া ও দেবী সম্পৎকরী

Subhadeep Saha

Subhadeep Saha is a Kolkata based freelance writer and commentator. He is an associate of The Saborno Sangrahalay - an evolving India studies resource centre in Kolkata.

0 Reviews

Related post