ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ১১

 ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ১১

সুধাসিন্ধোর্মধ্যে সুরবিটপিবাটীপরিবৃতে

মণিদ্বীপে নীপোপবনবতি চিন্তামণিগৃহে ।

শিবাকারে মঞ্চে পরমশিবপর্যঙ্কনিলয়াং

ভজন্তি ত্বাং ধন্যাঃ কতিচন চিদানন্দলহরীম্ ||

আনন্দ লহরী, শ্রীশঙ্করাচার্য

ব্রহ্মা-আদি সমস্ত ঋষিগণ দেবীকে দর্শন করতে এলেন। গরুড়বাহনে বিষ্ণু এলেন, বৃষভবাহনে মহেশ্বর এলেন। নারদাদি দেবর্ষিগণ, বিশ্বাবসু আদি গন্ধর্বগণ, অপ্সরাগণ সকলেই দেবীর দর্শনে এলেন ও স্তুতি-নতি করতে লাগলেন। পিতামহ ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্মা এক দিব্যনগরী রচনায় নিযুক্ত হলেন। সর্বমন্ত্রাধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গা, সর্ববিদ্যাধিষ্ঠাত্রী শ্যামা সকলেই আবির্ভূত হলেন। ব্রাহ্মী প্রমুখ অষ্টমাতৃকাগণ ভূত-ভৈরব, ক্ষেত্রপালগণ ও কোটি কোটি যোগিনীসহ আবির্ভূত হলেন। গণেশ্বর, বীরভদ্র, বটুক, কার্তিকেয় প্রমুখেরাও দেবীকে প্রণাম ও স্তুতি করতে এলেন।

     বিশ্বকর্মাবিনির্মিত নবনগরী রথশালা, অশ্বশালা, গজশালা, রাজবীথিকা, সুদৃশ্য বৃহদাকার তোরণ এবং অট্টালিকা দ্বারা সুসজ্জিত রয়েছে। সৈন্য-সামন্ত, অমাত্য, ব্রাহ্মণ, বেতাল এবং দাস-দাসীর জন্য পৃথক নিবাসস্থল বানানো হয়েছে। নগরীর মধ্যভাগে বহু সভা ও গোপুরমণ্ডিত রাজগৃহ রয়েছে। নবরত্নমণ্ডিত সিংহাসন-সভায় চিন্তামণি-নির্মিত দেবীর সিংহাসন ছিল। সামগ্রিক বিষয় অবলোকন করে পিতামহ ব্রহ্মা শিব-শক্তির রাজ্যাভিষেকের কথা চিন্তা করছিলেন। একদিকে শৃঙ্গাররসসম্পন্না ভগবতী পরমেশ্বরী ললিতা, অন্যদিকে জটাজুটধারী, ভস্মভূষিত শ্মশানচারী মহেশ্বর, কীভাবে এই মিলন সম্ভব, এই কথাই ব্রহ্মা চিন্তা করছিলেন।

     ব্রহ্মার সম্মুখে কোটি-কামদেব-নির্জিত লাবণ্যপ্রভামণ্ডিত দিব্যতনু মহেশ্বর। তাঁর রূপের আলোকে ত্রিভুবন আলোকময় হয়ে উঠল। রাজ-বসন, রাজ-আভূষণে সজ্জিত হয়েছেন মহেশ্বর। কিরীট-কুণ্ডলে সেজেছেন তিনি। তিনি অঙ্গে দিব্যচন্দন বিলেপন করেছেন ও দিব্যমালা ধারণ করেছেন। এমন কমনীয় রূপ দেখে আনন্দে মহেশ্বরকে আলিঙ্গন করলেন ব্রহ্মা। শিবের এই নবসুকুমার রূপের নাম রাখলেন, কামেশ্বর। ব্রহ্মা মহেশ্বরকে নিয়ে গেলেন ভগবতীর সম্মুখে। উভয়ের শুভদৃষ্টি বিনিময় হল। দেবীর মৃগশিশুর মতো নয়ন দেখে শিব প্রেমাসক্ত হলেন। শিবের সুকুমার রাজরূপ দর্শন করে দেবীও প্রেমবিমোহিত হলেন। ব্রহ্মা বললেন, “হে দেবী, আপনি আপনার সঙ্গী নির্বাচন করে এই মহানগরের সম্রাজ্ঞীরূপে অভিষিক্ত হউন। জগতজীবের সংরক্ষণ করুন। আপনি স্বয়ংযুতা, আপনিই পুরুষ, আপনিই প্রকৃতি। এই নিখিল বিশ্বের সমস্ত সাধক, জ্ঞানী সর্বদা আপনারই সন্ধানে নিরত থাকে। আপনি দয়া করে আপনার সমকক্ষ, সমস্বরূপ জীবনসঙ্গীকে বরমাল্য দ্বারা বরণ করুন।” ব্রহ্মার বচনে দেবী মৃদুল হেসে একটি দিব্যমাল্য শূন্যে ভাসিয়ে দিলেন আর সেই মালা মহাশূন্য থেকে ভেসে এসে দেবীর চিরন্তন সঙ্গী কামেশ্বর প্রভুর গলায় প্রক্ষিপ্ত হল। ব্রহ্মাদি দেবগণ উল্লাসধ্বনি করলেন। মহামেঘ থেকে পুষ্পবরিখন হল। ভগবান বিষ্ণু বললেন, শিব-শিবার বৈদিক বিধিতে বিবাহ সম্পন্ন করা উচিত।

     দেবগণের অনুরোধে ভগবান বিষ্ণু স্বয়ং কন্যাকে বরের হস্তে সম্প্রদান করলেন। ঋষিগণ বেদপাঠ করতে লাগলেন, সকলে মঙ্গলধ্বনি করে নবদম্পতিকে নানাবিধ উপহার দিলেন। ভগবান বিষ্ণু দিলেন ছত্র এবং পুষ্পবাণ, ভগবান ব্রহ্মা দিলেন ইক্ষু-ধনুক। বরুণ দিলেন নাগপাশ, বিশ্বকর্মা দিলেন তেজোময় অঙ্কুশ। অগ্নি দিলেন কিরীট, চন্দ্র দিলেন তাটঙ্কযুগল (কর্ণের অলংকার)। সমুদ্র দিলেন নবরত্নের ভূষণ। দেবরাজ ইন্দ্র এক উত্তম সুরাপাত্র দিলেন আর কুবের চিন্তামণি-হার দিলেন। গঙ্গা-যমুনা দিলেন চামরযুগল। অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, মরুৎগণ, গন্ধর্বগণ সকলেই নিজ নিজ অস্ত্র দান করলেন মহাদেবীকে।

     অম্লান মালায় শোভিত, ধ্বজা-চামর-ছত্রশোভিত ‘কুসুমাকর’ বিমানে এই দিব্যযুগল বিহার করলেন। চতুর্দিকে বীণা, বেণু, মৃদঙ্গ, তূর্য বাদন হতে লাগল। দেবগণ সেব্যের সেবার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছেন। বনবীথিকায় গমন করলেন আবার সুরম্য হর্ম্যে অপ্সরাগণের গীতবাদ্য শ্রবণ ও নৃত্য দর্শন করলেন। তারপর রাজসভায় উপবিষ্ট হয়ে সকলের মনষ্কামনা পূরণ করলেন। মহাদেবীর কৃপায় মহাকাশ থেকে নানান মূল্যবান বস্তু বর্ষিত হয়ে শ্রীনগরের সকল গৃহের শোভা বর্ধিত করল। চিন্তামণি, কামধেনু, কল্পবৃক্ষ প্রভৃতি সকল গৃহে অধিষ্ঠিত হল। দেব, গন্ধর্ব, অপ্সরা, ঋষি সকলেই এই নগরে নিশ্চিন্তে বসবাস করতে শুরু করল। পিতামহ ব্রহ্মা মহাদেবীকে কামাক্ষী কামেশ্বরী নামে অভিবাদন করলেন।    

সমস্ত জগতে দেবী কামাক্ষী স্নেহ, করুণা, কৃপায় ভরিয়ে রাখলেন। এমন আর কখনও হয়নি। এভাবেই দশ সহস্র বছর, যেন ক্ষণিকের মতো ব্যতীত হয়ে গেল। তারপর একদিন দেবর্ষি নারদ এলেন দেবীর কাছে।

Subhadeep Saha

Subhadeep Saha is a Kolkata based freelance writer and commentator. He is an associate of The Saborno Sangrahalay - an evolving India studies resource centre in Kolkata.

0 Reviews

Related post