ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ১০

 ললিতা-উপাখ্যান: ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর মাহাত্ম্যকথন – ১০

দেবগণের দশ সহস্র বৎসরের তপস্যার পর দৈত্যকুলের মোহভঙ্গ হল। দৈত্যগণ সৈন্যসামন্ত-সহ হিমালয় পর্বতের দিকে ছুটে আসতে লাগল। তপস্যারত দেবগণ দৈত্যদের আগমনের বার্তা পেয়ে ভীত হলেন। ততক্ষণে দৈত্যসেনা হিমালয়তট বেষ্টন করে ফেলেছে। দেবরাজ ইন্দ্র বললেন, “হে দেবগণ, এই মুহূর্তে আমরা যদি যুদ্ধ করি, তবে এই মদোন্মত্ত দৈত্যসেনার কাছে পরাজয় নিশ্চিত। যদি পলায়ন করি, তবে আমাদের এই তপস্যা নিষ্ফল হবে এবং আমাদের অন্য কোনও গতি অবশিষ্ট থাকবে না। তাই, আমরা সকলে মিলে আমাদের কার্য সম্পূর্ণ করি। যোজন-বিস্তৃত মহাকুণ্ডে মহাযাগের আয়োজন করে হুতাশনে মাংসাদি উপচার দ্বারা দেবী ভগবতী পরাশক্তির আরাধনা করি। পরাশক্তি বিনা আমাদের অন্য গতি নেই। একমাত্র তিনিই পারেন আমাদের উদ্ধার করতে।”

     দেবগণ যজ্ঞাগ্নি প্রজ্জ্বলন করে বিধিপূর্বক পরাশক্তির আবাহন করলেন। তারপর আপন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে মাংস কর্তন ও শোধন করে যজ্ঞকুণ্ডে আহুতি দিতে লাগলেন। দেবগণের দেহের সকল মাংস যখন প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে, দেবগণ নিজেদের সম্পূর্ণ আহুতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ঠিক তখনই সেই যোজনবিস্তৃত যজ্ঞকুণ্ড থেকে এক মহত্তেজোপিণ্ডের উদ্ভব হল। সেই মহাতেজ কোটি-কোটি সূর্যের সমান জাজ্জ্বল্যমান। সেই তেজোপিণ্ড ক্রমশ একটি যন্ত্রময় রথের আকার ধারণ করল। সেই ‘শ্রীযন্ত্র’ মধ্যে উপবিষ্ট রয়েছেন, দেবী ভগবতী ললিতা পরাভট্টারিকা। তিনি জগতের উজ্জীবনকারিণী, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবাত্মিকা। তিনি সৌন্দর্যের অন্তিম সীমা, আনন্দরস-সমুদ্রসমা। তিনি জবা-কুসুমের মতো রক্তবর্ণা এবং দাড়িমীকুসুমের মতো বসন-পরিহিতা, সকল অলংকারে অলংকৃতা, শৃঙ্গার-রসের আকর তিনিই। তিনি অপাঙ্গদৃষ্টিতে ত্রিজগতে করুণারসের তরঙ্গ সৃষ্টি করেছেন। তিনি চতুর্ভুজে পাশ-অঙ্কুশ এবং ইক্ষুধনুক-পঞ্চবাণ ধারণ করে চতুর্দিক ব্যাপ্ত করে আছেন। তাঁর দর্শনলাভ মাত্রেই দেবগণ আপন আপন অঙ্গ ফিরে পেলেন এবং বজ্রদেহ লাভ করলেন। এই মহাদেবীকে তাঁরা বারংবার প্রণাম ও স্তব করতে লাগবেন।

ললিতা স্তবরাজ

দেবগণ বললেন,

জয় দেবি জগন্মাতর্জয় দেবি পরাৎপরে।

জয় কল্যাণনিলয়ে জয় কামকলাত্মিকে॥

জয়কারি চ বামাক্ষি জয় কামাক্ষি সুন্দরি।

জয়াখিলসুরারাধ্যে জয় কামেশি মানদে॥

জয় ব্রহ্মময়ে দেবি ব্রহ্মাত্মকরসাত্মিকে।

জয় নারায়ণি পরে নন্দিতাশেষবিষ্টপে॥

জয় শ্রীকণ্ঠদয়িতে জয় শ্রীললিতেঽম্বিকে।

জয় শ্রীবিজয়ে দেবি বিজয়শ্রীসমৃদ্ধিদে॥

জাতস্য জায়মানস্য ইষ্টাপূর্তস্য হেতবে।

নমস্তস্যৈ ত্রিজগতাং পালয়িত্র্যৈ পরাৎপরে॥

কলামুহূর্তকাষ্ঠাহর্মাসর্তুশরদাত্মনে।

নমঃ সহস্রশীর্ষায়ৈ সহস্রমুখলোচনে॥

নমঃ সহস্রহস্তাব্জপাদপঙ্কজশোভিতে।

অণোরণুতরে দেবি মহতোঽপি মহীয়সি॥

পরাৎপরতরে মাতস্তেজস্তেজীয়সামপি।

অতলং তু ভবেৎপাদৌ বিতলং জানুনী তব॥

রসাতলং কটীদেশঃ কুক্ষিস্তে ধরণী ভবেৎ।

হৃদয়ং তু ভুবর্লোকঃ স্বস্তে মুখমুদাহৃতম্॥

দৃশশ্চন্দ্রার্কদহনা দিশস্তে বাহবোঽম্বিকে।

মরুতস্তু তবোচ্ছ্বাসা বাচস্তে শ্রুতয়োঽখিলাঃ॥

ক্রীডা তে লোকরচনা সখা তে চিন্ময়ঃ শিবঃ।

আহারস্তে সদানন্দো বাসস্তে হৃদয়ে সতাম্॥

দৃশ্যাদৃশ্যস্বরূপাণি রূপাণি ভুবনানি তে।

শিরোরুহা ঘনাস্তে তু তারকাঃ কুসুমানি তে॥

ধর্মাদ্যা বাহবস্তে স্যুরধর্মাদ্যায়ুধানি তে।

যমাশ্চ নিয়মাশ্চৈব করপাদরুহাস্তথা॥

স্তনৌ স্বাহাস্বধাঽঽকরৌ লোকোজ্জীবনকারকৌ।

প্রাণায়ামস্তু তে নাসা রসনা তে সরস্বতী॥

প্রত্যাহারস্ত্বিন্দ্রিয়াণি ধ্যানং তে ধীস্তু সত্তমা।

মনস্তে ধারণাশক্তির্হৃদয়ং তে সমাধিকঃ॥

মহীরুহাস্তেঽঙ্গরুহাঃ প্রভাতং বসনং তব।

ভূতং ভব্যং ভবিষ্যচ্চ নিত্যং চ তব বিগ্রহঃ॥

যজ্ঞরূপা জগদ্ধাত্রী বিশ্বরূপা চ পাবনী।

আদৌ যা তু দয়াভূতা সসর্জ নিখিলাঃ প্রজাঃ॥

হৃদয়স্থাপি লোকানামদৃশ্যা মোহনাত্মিকা।

নামরূপবিভাগং চ যা করোতি স্বলীলয়া॥

তান্যধিষ্ঠায় তিষ্ঠন্তী তেষ্বসক্তার্থকামদা।

নমস্তস্যৈ মহাদেব্যৈ সর্বশক্ত্যৈ নমোনমঃ॥

যা দেবী পরমাশক্তিঃ পরব্রহ্মাভিধায়িনী।

ব্রহ্মানন্দাভিদায়িন্যৈ তস্যৈ দেব্যৈ নমো নমঃ॥

যদাজ্ঞয়া প্রবর্তন্তে বহ্নিসূর্যেন্দুমারুতাঃ।

পৃথিব্যাদীনি ভূতানি তস্যৈ দেব্যৈ নমোনমঃ॥

যা সসর্জাদিধাতারং সর্গাদাবাদিভূরিদম্।

দধার স্বয়মেবৈকা তস্যৈ দেব্যৈ নমোনমঃ॥

যথা ধৃতা তু ধরণী যয়াঽঽকাশমমেয়যা।

যস্যামুদেতি সবিতা তস্যৈ দেব্যৈ নমোনমঃ॥

যদন্তরস্থং ত্রিদিবং যদাধারোঽন্তরিক্ষকঃ।

যন্ময়শ্চাখিলো লোকঃ তস্য দেবৈ নমো নমঃ॥

যত্রোদেতি জগৎকৃৎস্নং যত্র তিষ্ঠতি নির্ভরম্।

যত্রান্তমেতি কালে তু তস্যৈ দেব্যৈ নমোনমঃ॥

নমোনমস্তে রজসে ভবায়ৈ নমোনমঃ সাত্ত্বিকসংস্থিতায়ৈ।

নমোনমস্তে তমসে হরায়ৈ নমোনমো নির্গুণতঃ শিবায়ৈ॥

নমোনমস্তে জগদেকমাত্রে নমোনমস্তে জগদেকপিত্রে।

নমোনমস্তেঽখিলরূপতন্ত্রে নমোনমস্তেঽখিলযন্ত্ররূপে॥

নমোনমো লোকগুরুপ্রধানে নমোনমস্তেঽখিলবাগ্বিভূত্যৈ।

নমোঽস্তু লক্ষ্ম্যৈ জগদেকতুষ্ট্যৈ নমোনমঃ শাম্ভবি সর্বশক্ত্যৈ॥

অনাদিমধ্যান্তমপাঞ্চভৌতিকং হ্যবাঙ্মনোগম্যমতর্ক্যবৈভবম্।

অরূপমদ্বন্দ্বমদৃষ্টগোচরং প্রভাবমগ্র্যং কথমম্ব বর্ণয়ে॥

প্রসীদ বিশ্বেশ্বরি বিশ্ববন্দিতে প্রসীদ বিদ্যেশ্বরি বেদরূপিণি।

প্রসীদ মায়াময়ি মন্ত্রবিগ্রহে প্রসীদ সর্বেশ্বরি সর্বরূপিণি॥

দেবী পরাভগবতী ললিতা, দেবগণের এহেন স্তববন্দনায় সন্তুষ্ট হয়ে বরপ্রদানে ইচ্ছুক হলেন। দেবরাজ ইন্দ্র বললেন, “হে দেবী আপনি যদি সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন, তবে আপনার চরণাশ্রিত এই দেবগণকে দুর্ধর্ষ দৈত্যের পীড়ন থেকে উদ্ধার করুন।” দেবী বললেন, “হে দেবগণ, তোমরা নির্ভয় হও। আমি দৈত্যকুলোদ্ভব ভণ্ডকে পরাস্ত করে ত্রিজগত আবার তোমাদের ফিরিয়ে দেব। দেবগণ ও নর-নারী ধর্মশ্রী প্রাপ্ত হয়ে নীরোগ ও যশভাজন হয়ে সুখে বাস করবে।”

দেবগণ পরাশক্তি ভগবতীকে বারংবার দর্শন করে আনন্দ লাভ করলেন ও প্রণত হলেন।

Subhadeep Saha

Subhadeep Saha is a Kolkata based freelance writer and commentator. He is an associate of The Saborno Sangrahalay - an evolving India studies resource centre in Kolkata.

0 Reviews

Related post