স্বদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা: একটি প্রসঙ্গচারণা

 স্বদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা: একটি প্রসঙ্গচারণা

ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস প্রাচীন। সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতের প্রাচীন জনপদগুলির মধ্যে মানবসভ্যতা, সমাজগঠন ও দর্শনশাস্ত্র বিষয়ক গূঢ়তত্ত্বের আলোচনা, চর্চা ও বিন্যাস পরিলক্ষিত হয়। তক্ষশীলা, নালন্দার মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তৎকালীন সময়েও দেশের বাইরে প্রভূত খ্যাতিলাভ করেছিল। উচ্চশিক্ষার এইরূপ সুবৃহৎ প্রতিষ্ঠানসমূহের ধারাবাহিকতা ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। অবশ্য উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে এইরূপ বৃহৎ সাফল্যের পিছনে নিঃসন্দেহে ছিল এক সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষাউদ্যোগ। জাতির সর্বস্তরে যদি প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার সেই যুগে না হয়ে থাকত তাহলে তক্ষশীলা বা নালন্দার সৃজন ও বহু শতাব্দীব্যাপী পরিপালন ভারতীয়দের কাছে অধরাই থেকে যেত। ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভূত বহুশাস্ত্রবিদ্ পণ্ডিত চাণক্য ও তাঁর সুযোগ্য শিষ্য শুদ্রকুলোদ্ভূত সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের ঐতিহাসিক অধ্যায় হতে আমরা নিঃসন্দেহে বঞ্চিত হতাম, যদি না আমাদের প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা সঠিক অর্থে সর্বজনীন হত। 

আমরা সকলেই জানি, প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষকে বহু ঝড়ঝঞ্ঝা, যুদ্ধবিগ্রহের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকগুলি আমাদের দেশের আক্রমণকারীদের এবং ভিনদেশীয় দখলদারী রাজাদের মহান বলতে শেখায়। ম্যাসিডোনিয়ার রাজা ফিলিপের পুত্র আলেকজ়ান্ডার নিঃসন্দেহে গ্রিকদের কাছে মহান বীরপুরুষ। কিন্তু ভারত আক্রমণকারী ও আমাদের দেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে বিস্তৃত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ধ্বংসলীলা সাধনকারী আলেকজ়ান্ডারকে যখন আমাদের স্বদেশীয় পাঠ্যপুস্তক ‘দ্য গ্রেট’ হিসাবে অভিহিত করে তখন তার থেকে লজ্জাজনক আর কিছু হতে পারে না। এইরূপ বিবিধ প্রচেষ্টার মধ্যে ভারতীয় সভ্যতা ও সমাজের সঠিক ইতিহাস আজ অনেকটাই ধামাচাপা পড়ে গেছে। অধুনা ভারতীয়রা আজ হয়তো অনেকেই জানেন না, বিশ্ববরেণ্য নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসলীলা কীরূপে সাধিত হয়েছিল। বর্তমান প্রজন্মের বাঙালিরাও হয়তো অনেকেই জানেন না যে, আজ থেকে মাত্র দুশো-আড়াইশো বছর আগে নদীয়া জেলার নবদ্বীপে এক প্রাণবন্ত উচ্চশিক্ষাকেন্দ্র ছিল, যেখানে সারা ভারতবর্ষ থেকে ছাত্ররা গুরুগৃহে অধ্যয়ন করতে আসত। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত ব্রিটিশ ভারততত্ত্ববিদ্ চিফ জাস্টিস স্যার উইলিয়াম জোন্স অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে নদীয়ায় আসেন এবং নবদ্বীপেকে এক বিশ্ববিদ্যালয় মনে করেন এবং দেখেন সেখানে অন্তত পাঁচ হাজার ছাত্র গুরুগৃহে বসবাস করে শিক্ষালাভ করছে। সেসময়ে নবদ্বীপে অন্তত দেড় হাজার অধ্যাপকের বাস ছিল, যাঁরা শাস্ত্র, ব্যাকরণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্যাচর্চা ও অধ্যাপনা করতেন। নবদ্বীপ বিদ্যাসমাজের ইতিহাস অন্ততপক্ষে হাজার বছরের প্রাচীন। নব্যন্যায় চর্চার ক্ষেত্রে নবদ্বীপের ছিল ভারতজোড়া খ্যাতি। নবদ্বীপের এই কৃষ্টি হতেই নিমাই পণ্ডিতের উদয় এবং পরবর্তীতে ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু’-রূপে তাঁর আসমুদ্রহিমাচল ভারত অন্বেষণ। দেশগঠনের কাজে স্বদেশচর্চার এই সমস্ত উপাদানগুলি আমাদের বিস্মৃত হলে চলবে না।

খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর পর ইসলামিক আগ্রাসনের কারণে সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে এক চূড়ান্ত অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। বৈদেশিক আক্রমণের সময় মানুষের প্রধান কর্তব্য স্বভাবতই নিজের প্রাণ বাঁচানো। এমন অস্থির সময়ে ভারতীয়রা তাঁদের সভ্যতার প্রাচীন প্রতিষ্ঠানগুলিকে আর বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হননি। নালন্দা, বিক্রমশীলার মতো উচ্চশিক্ষার পীঠস্থানগুলি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থাটি কিন্তু ব্রিটিশরা ভারতে আসা অবধি টিঁকে থাকে। 

উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমে ভারতে যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা হল তখন আমাদের তৎকালীন রাষ্ট্রনেতারা অনেকেই লক্ষ করলেন যে, সরকারী বা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় সমাজের অধিকাংশ মানুষেরই কোনও অংশগ্রহণ নেই। সেকালে যথাযোগ্য ইংরেজি শিক্ষালাভ না করতে পারলে সরকারী চাকুরী ভারতীয়দের কাছে অধরাই থেকে যেত। কিন্তু ১৮৭১ সাল থেকে শুরু হওয়া আদম সুমারীতে আমরা দেখতে পাই, ব্রিটিশশাসিত ভারতে সরকারী শিক্ষাব্যবস্থায় ভারতীয়দের সাক্ষরতার হার ছিল অত্যন্ত নগন্য। আর ইংরেজিতে দেশীয় মানুষদের সাক্ষরতার হারের কথা না বলাই ভালো। অনেক পণ্ডিত ও তদানীন্তন ইংরেজ রাজপুরুষগণ আমাদের জানিয়ে গিয়েছেন যে, ভারতীয়দের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও সাক্ষরতার হার কম হওয়ার দরুণ ভারতীয় সমাজব্যবস্থার চারিত্রিক গঠন বা শ্রেণীবিভাগই নাকি দায়ী। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর মতো রাষ্ট্রনেতারা, যাঁরা ভারতবর্ষের সামাজিক ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন, তাঁরা এই তত্ত্ব মানতে অস্বীকার করেন। ১৯৩১ সালের ২০ অক্টোবর লন্ডনের এক বক্তৃতাসভায় গান্ধীজী দাবী করেন যে, “আজ থেকে পঞ্চাশ অথবা একশো বছর আগে ব্রিটিশশাসিত ভারত তথা ব্রহ্মদেশ অনেক বেশি সাক্ষর ছিল।” তিনি আরও দাবী করেন যে, ভারতীয় স্বদেশী শিক্ষাব্যবস্থা এক সুন্দর বটবৃক্ষের মতো ছিল। ব্রিটিশ শাসনকর্তারা ভারতে আসার পর এই সুন্দর বৃক্ষের পোষণ রোধ করে তাকে ধ্বংস করে। 

গান্ধীজীর এই দাবী তৎকালীন লন্ডন বিদ্বৎ সমাজে বিতর্কের ঝড় তোলে। ১৯৩১-এর ২০ অক্টোবরের সেই সভায় ‘ভারতের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক বক্তৃতা গান্ধীজীর গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতাগুলির মধ্যে অগ্রগণ্য। সেদিনের সেই সভায় ইংলন্ডের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ব্রিটিশ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ লোকজন উপস্থিত ছিলেন। এঁদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য স্যার ফিলিপ হারটোগ্। গান্ধীজীর বক্তৃতা শেষ হওয়ামাত্রই স্যার ফিলিপ গান্ধীজীর দেওয়া ‘ব্রিটিশ শাসন কায়েম হওয়ার আগে ভারতীয়দের মধ্যে সাক্ষরতা’-র পরিসংখ্যানের তথ্যে আপত্তি ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন, তিনি বলেন, হয় গান্ধীজীকে তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ পেশ করতে হবে, নচেৎ তাঁকে তাঁর বক্তব্য ফিরিয়ে নিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। ভারতীয় সমাজব্যবস্থা ও সভ্যতার বিন্যাস সম্পর্কে গান্ধীজী ছিলেন সম্যক অবগত ও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তিনি সর্বসমক্ষে জানান, তিনি তাঁর পরিসংখ্যানে অনড় থাকবেন এবং দেশে ফিরে এর সপক্ষে যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণও দেবেন। 

অবশ্য দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠক হতে দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে গান্ধীজীকে কারারুদ্ধ হতে হয়। কিন্তু সত্যান্বেষী গান্ধীজী স্যার ফিলিপ হারটোগকে যথাযোগ্য উত্তর দেওয়া থেকে নিজেকে নিরস্ত রাখেননি। প্রথমেই তিনি নিজের সম্পাদিত ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় ৮ ও ২৯ ডিসেম্বর ১৯২০ সালে প্রকাশিত দৌলতরাম গুপ্তা লিখিত স্বদেশী শিক্ষাব্যবস্থা সংক্রান্ত দুটি প্রবন্ধের কপি পাঠান। পরবর্তীকালে, তিনি তৎকালীন ভারতের অগ্রগণ্য শিক্ষাবিদ্ অধ্যাপক কে.টি. শাহ্ ও ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেন ফিলিপ হারটোগকে জবাব দেওয়ার জন্য। ১৯৩২-এর ফেব্রুয়ারিতে অধ্যাপক শাহ্, স্যার ফিলিপকে স্বদেশী শিক্ষাব্যবস্থা ও ব্রিটিশ পূর্ববর্তী ভারতে স্থানীয়দের মধ্যে বর্ধিত সাক্ষরতার হার সংক্রান্ত এক বিস্তৃত প্রবন্ধ তৈরি করে পাঠান। পরবর্তীকালে ১৯৩৯ সালে উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আদেশানুসারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার অনাথনাথ বসুও একটি নোট প্রস্তুত করেন। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিযুগে স্বদেশী শিক্ষাব্যবস্থাসংক্রান্ত এই বিতর্ক ধামাচাপা পড়ে যায়। গান্ধীজী কিন্তু স্বদেশী শিক্ষাব্যবস্থাকেন্দ্রিক তাঁর ধ্যানধারণা থেকে কখনোই বিচ্যুত হননি। ১৯০৯ সালে রচিত তাঁর নিজস্ব পলিটিক্যাল ম্যানিফেস্টো ‘হিন্দ স্বরাজ’ থেকে আমৃত্যু মনে করে গেছেন যে, আমাদের প্রাচীন স্বদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থাই যথেষ্ট। গ্রাম্য স্কুলশিক্ষাব্যবস্থার পুনরুদ্ধার স্বাধীন ভারতে অপরিহার্য। যে শিক্ষাব্যবস্থায় চরিত্রের গঠন সাধিত হয়, সেই ব্যবস্থাই একমাত্র উপাদেয় প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা হওয়ার যোগ্যতা রাখে বলে গান্ধীজী মনে করতেন। 

গান্ধীজীর মৃত্যুর দুই দশক পরে তাঁরই দেখানো পথের এক মধ্যবয়স্ক দিশারী ধরমপাল (১৯২২-২০০৬) গান্ধীজীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইতিহাস অন্বেষণে নেমে পড়েন। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন অভিলেখ্যাগারে তিনি খুঁজতে আরম্ভ করেন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিভিন্ন কাগজপত্র। যখন তিনি প্রায় কুড়ি বছর পর দেশে ফেরেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন কুড়ি পেটরা ভর্তি দলিলদস্তাবেজের রসদ। ব্রিটিশ ভারতের সাহিত্যাশ্রয়ী এই ঐতিহাসিক উপাদানগুলিই ধরমপালকে স্বদেশচর্চার নতুন আঙ্গিক নির্মাণ করতে সাহায্য করে। ব্রিটিশ আগ্রাসনের পূর্ববর্তী ভারতবর্ষে বিজ্ঞানচর্চা, শিক্ষাব্যবস্থা ও তার প্রসার, সমাজব্যবস্থা, দেশীয় অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে আমৃত্যু একের পর এক আকর কাজ তিনি করে গেছেন। ১৯৮৩ সালে দিল্লি থেকে প্রকাশিত হয় ধরমপালের অন্যতম জনপ্রিয় বই, ‘দ্য বিউটিফুল ট্রি’। এই মহতী গবেষণামূলক আকর গ্রন্থ দ্বারা ধরমপাল ১৯৩১ সালে গান্ধীজী তাঁর প্রদত্ত ভাষণে বৃটিশ শাসনের পূর্বেকার ভারতবর্ষের স্বদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা ও তার প্রসার এবং ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের তুলনায় সেই সময়কার ভারতীয়রা অধিক সাক্ষর ছিলেন বলে যে দাবি করেছিলেন, তার সত্যতা প্রমাণ করেন। ধরমপাল তাঁর এই বইটিতে উনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশ প্রশাসন কর্তৃক ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে স্বদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার হালহকিকত জানতে যে সুমারি করেছিল তার সারাংশ পাঠকবর্গের সামনে তুলে ধরেছেন। 

১৮২০-২৫ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে গভর্নর থমাস মুনরো-র নির্দেশে স্বদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার জানার জন্য এক জেলাভিত্তিক সুমারি হয়। পরবর্তীকালে বম্বে প্রেসিডেন্সির কিয়দংশে অনুরূপ এক সুমারির আয়োজন করেন গভর্নর এলফিনস্টোন। ১৮৩৫ সালে গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর আদেশবলে উইলিয়াম অ্যডাম বাংলার বীরভূম, বর্ধমান, দক্ষিণ বিহার, তিরহুট ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এবং রাজশাহী জেলার নাটোর থানা অঞ্চলে স্বদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার উপর এক গবেষণামূলক সুমারি চালান। পরবর্তীকালে জি.ডব্লু. লাইটেনার নামক এক ব্রিটিশ ভারততত্ত্ববিদ্ পাঞ্জাব প্রদেশে স্বদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তৃতি ও সাক্ষরতার হার নিয়ে এক অনুসন্ধান রিপোর্ট বানান। ধরমপালের ‘দ্য বিউটিফুল ট্রি’ বইটিতে এই সমস্ত দলিলদস্তাবেজ ঠাঁই পেয়েছে। এই সমস্ত তথ্যাদি পাঠকবর্গ ও তরুণ গবেষকরা অধ্যয়ন করলে সহজেই অনুমান করতে পারবেন, ভারতীয় বিদ্যাসমাজের ইতিহাস কতটা ভ্রান্ত ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের তুলনায় ব্রিটিশ আগ্রাসনে পতিত হওয়ার সময়কার ভারতবর্ষেও স্বদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তৃতি ছিল প্রশংসনীয় ও তার ভিত ছিল মজবুত। প্রতি গ্রামে বালকদের জন্য অন্ততঃ একটি করে স্কুলের ব্যবস্থা ছিল। এই সমস্ত গ্রামীণ স্কুলের ছাত্রদের ভাষাশিক্ষা ও গণিতের পাশাপাশি সাহিত্য ও হিতোপদেশের জ্ঞানও দেওয়া হত। পাঁচ থেকে আট বছরকাল গ্রামের ছেলেরা গ্রামের স্কুলে পড়ার পর সাক্ষর হয়ে উঠত। এই শিক্ষাব্যবস্থার ভরণপোষণ স্থানীয় মানুষজনেরাই করত। এতে ছিল না শাসনতন্ত্রের কোনও প্রভাব। দিল্লির কোনও বাবু ঠিক করে দিতেন না সুদূর রামনাথাপুরমের গ্রামের স্কুলের পাঠ্যসূচী কী হবে। ব্রিটিশরা ভারতের শাসনব্যবস্থা করায়ত্ত করার পর ভারতীয়দের এই প্রাচীন, সুন্দর স্বদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা অচিরেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ব্রিটিশদের এইরূপ শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি কোনও আগ্রহই ছিল না। তারা নিজেদের দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার অনুকরণে ভারতে সরকারী সাহায্যে অনুমোদনপ্রাপ্ত এক নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রনয়ণ করে। এর ফলে উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের মধ্যেই নবদ্বীপ বা কাশীর ন্যায় প্রাচীন বিদ্যাসমাজগুলির অবলুপ্তি ঘটে। নতুন নিয়মে শিক্ষিত ভারতীয়রা ইংরেজ শাসনের কাছে সাংস্কৃতিক দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। আজও আমরা, স্বাধীনতার সাত দশক পরেও, এই সাংস্কৃতিক দাসত্বের নাগপাশ থেকে নিজেদের কতটা মুক্ত হতে পেরেছি জানি না। আমরা যারা নতুন ভারত গঠনের স্বপ্ন দেখি, তাদের কাছে স্বদেশীয় ইতিহাসের এই বিস্মৃত উপাদানগুলিই পাথেয়। নতুনের আগ্রহ স্বাভাবিক, কিন্তু নতুনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে চিরায়তকে ভুললে চলবে না।

Probal Roy Chowdhury

Dr Probal Roy Chowdhury is an independent researcher and educational consultant. He currently engages in scholarly explorations on the history of indigenous education in modern India and on cultural and ritual traditions of Bengal, especially the Durga Puja festival. He is the founder-secretary of The Saborno Sangrahalay - an evolving India studies resource centre in Kolkata

0 Reviews

Related post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *