শ্রীরামকৃষ্ণ-সঙ্ঘজননী শ্রীমা সারদা দেবী

 শ্রীরামকৃষ্ণ-সঙ্ঘজননী শ্রীমা সারদা দেবী

সারদামণি দেবী, যিনি ‘শ্রীশ্রীমা’ নামেই সমধিক পরিচিতা, বিগত  শতকের ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে, এক উজ্জ্বল জ্যোতির্ময়ী নক্ষত্র। তাঁর স্নেহপাশে বাঁধা পড়েছে দেশ এবং বিদেশের অগণিত নরনারী। তাঁর শাসনে সন্ন্যাসীরা পেয়েছেন বৈদান্তিক কঠোরতা। তাঁর প্রশ্রয়ে গড়ে উঠেছে শয়ে শয়ে লোককল্যাণমূলক উদ্যোগ। তিনি একদিকে স্নেহশীলা মা, বাৎসল্যের আধার। অন্যদিকে, সন্তানের কল্যাণে তিনিই রুদ্রাণী চণ্ডী। তাঁর অনুধ্যানে অন্তঃপুরের স্ত্রীশক্তি শিক্ষার আলোকে, নবচেতনার উন্মেষে জাগ্রত হয়। এই মহাজীবনের জন্মতিথির পুণ্যলগ্নে আমরা নতশিরে তাঁর প্রসঙ্গেই আলোচনা করার চেষ্টা করব।

১৮৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ২২ তারিখে বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামে সারদামণির জন্ম হয়। খুব কম বয়সে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে। বাল্যবিবাহ হলেও তিনি কৈশোরের শেষপ্রান্তে এসে দক্ষিণেশ্বর ভবতারিণী মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গলাভ করেন। বৈবাহিক সম্পর্ক নয়, গড়ে ওঠে গুরু-শিষ্যার সম্পর্ক। সাধনজীবন ও লৌকিক জীবন সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে শিক্ষালাভ করেন। গ্রাম্য মেয়ে ধীরে ধীরে পরিণত হতে থাকেন ভবিষ্যতের সঙ্ঘজননীরূপে। দক্ষিণেশ্বরে থাকার সময় থেকেই শ্রীরামকৃষ্ণানুরাগী ভক্তবৃন্দের কাছে তিনি জননীর আসনে প্রতিষ্ঠিতা হন। গার্হস্থ্য ও সন্ন্যাস জীবনের এক অদ্ভুত মিলনে তিনি সংসারী ও সন্ন্যাসী উভয়েরই আদর্শ হিসেবে প্রতিপন্ন হন। বাংলার বাৎসল্যের আদর্শ প্রতীক ছিলেন শ্রীশ্রীমা। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহাবসানের পর তিনি কামারপুকুর, জয়রামবাটী ও পরে বাগবাজারে উদ্বোধন কার্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে সেখানেই বাকি জীবন অতিবাহিত করেন।

আজকের বেলুড় মঠ ও মিশন এবং তৎসংক্রান্ত সমস্ত কার্যক্রমের প্রধান প্রেরণাদাত্রী ছিলেন শ্রীশ্রীমা। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহাবসানের পর তরুণ সন্তানেরা একে একে গৃহত্যাগ করে একত্রে সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন। কিন্তু তাঁদের কোনও নিরাপদ আশ্রয় ছিল না, যেখান থেকে তাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণের ‘জীবসেবাই শিবসেবা;—এই মন্ত্রটির সাকার রূপ দেবেন। শ্রীশ্রীমার আকুল প্রার্থনায় ঈশ্বরের কৃপায় বহুজনের আনুকূল্যে অবশেষে বেলুড় মঠের জমি কেনা হয়। সন্ন্যাসীদের ক্রমাগত প্রেরণাদানেই স্থাপিত হয় বেলুড় মঠ। নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি তাঁর সন্তানদের কখনও হতোদ্যম হতে দেননি। কলকাতায় প্লেগ মহামারীর সময়ে স্বামী বিবেকানন্দ চেয়েছিলেন মঠের জমি বিক্রয় করে দিতে। শ্রীশ্রীমা তাতে বাধা দিয়ে আশ্বস্ত করেন। তিনি ভবিষ্যতদ্রষ্টী ছিলেন, এবং নেতৃত্বদানে অতুল্যা। আজ বেলুড় মঠের অস্তিত্বই সে কথা প্রমাণ করে। 

দুই বাংলার অজস্র নরনারীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন শ্রীশ্রীমা। জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত বিধ্বস্ত হতে হতে তাঁরা এসে পৌঁছাতেন মায়ের কাছে। আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে জীবনচর্যাকে একসূত্রে বেঁধে দিয়ে মা তাঁদের সংসারসংগ্রামে বিজয় প্রদান করতেন। তিনি বলতেন, এক হাতে ঠাকুরকে ধরে রেখে অন্য হাতে সংসার করবার কথা। নারী-পুরুষ সকলেই তাঁর কাছে আশ্রয় পেয়েছেন, মায়ের কাছে ভেদ ছিল না। মায়ের কাছে ভেদ ছিল না জাতিধর্মেরও। অনুগত মাত্রেই তিনি কৃপা করতেন। তাঁর কথাতেই, “আমার শরৎ (স্বামী সারদানন্দ) যেমন ছেলে, আমজাদও তেমন ছেলে।” এমন করেই আশ্রয় দিয়েছিলেন বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীকে। স্বামীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত বিপ্লবীরা শ্রীশ্রীমা-কেই আঁকড়ে ধরেছিলেন। শ্রীঅরবিন্দ, দেবব্রত বসু, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন), বিভূতিভূষণ ঘোষ, বিজয়কৃষ্ণ বসু, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য রাধিকামোহন গোস্বামী, ধীরেন দাশগুপ্ত, নগেন সরকার, কর্ণাটকুমার চৌধুরী, প্রমুখ আরও অনেকে। এঁদের মধ্যেই অনেককেই মা দীক্ষা দিয়ে আধ্যাত্মিক আন্দোলনের শরিক করেছিলেন। তাঁর কৃপাধন্য ভগিনী নিবেদিতাও পরে বিপ্লবী কর্মসূচীতে জড়িয়ে পড়েন। ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচারের খবর শুনে মা একবার রণক্ষেত্রে চণ্ডীর মতো অট্টহাসি করেছিলেন। কিন্তু আবার তিনিই কখনও ব্রিটিশদের অকল্যাণ কামনা করেননি, তারাও যে তাঁর সন্তান, এই বোধ ছিল তাঁর মনে। তাই তো আজও তিনি পূজিতা বিশ্বমাতৃকারূপে, জগদ্ধাত্রীরূপে, জগজ্জননীরূপে এবং ‘সত্যিকারের মা’ রূপে।   

শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘ তো কেবল কতিপয় সন্ন্যাসী সন্তান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবান্দোলন সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে যে বিপ্লব এনেছিল এবং তাতে যাঁরা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে যুক্ত হয়েছিলেন তাঁদের প্রত্যেকেই শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের হোতা। সে মায়ের সন্ন্যাসী সন্তানই হোন, বিপ্লবী সন্তানই হোন, মাতাল বিনোদই হোন বা ভগিনী নিবেদিতা বা গৌরীমায়ের মতো নারীশিক্ষায় ব্রতী মানুষই হোন, মায়ের স্নেহ, প্রেরণা ছিল সর্বমুখী। তিনি তাই নিজমুখেই বলেছিলেন, তিনি সত্যিকারের মা। 

Ganesh Thakur

0 Reviews

Related post