রাস-পঞ্চাধ্যায়ী

 রাস-পঞ্চাধ্যায়ী

গুরবে গৌরচন্দ্রায় রাধিকায়ৈ তদালয়ে।

কৃষ্ণায় কৃষ্ণভক্তায় তদ্ভক্তায় নমো নমঃ।।

বাঞ্ছাকল্পতরুভ্যশ্চ কৃপাসিন্ধুভ্য এব চ।

পতিতানাং পাবনেভ্যো বৈষ্ণবেভ্যো নমো নমঃ।।

শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের ঊনত্রিংশতি থেকে ত্রয়স্ত্রিংশতি অধ্যায়, সর্বমোট পাঁচটি অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা। মনে রাখতে হবে, শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণের এই অপ্রাকৃত কাহিনি বর্ণনা করছেন ব্রহ্মজ্ঞানী শুকদেব, এবং শ্রবণ করছেন মৃত্যুপথযাত্রী মহারাজা পরীক্ষিত, ব্রহ্মশাপে যিনি সাতদিনের মধ্যে তক্ষক-দংশনে দেহত্যাগ করবেন। মহারাজ পরীক্ষিত মুমুক্ষু অবস্থায় পুত্র জনমেজয়কে সাম্রাজ্যভার সমর্পণ করে ছুটে এসেছেন বনে। আর শুকদেবের কথা কী বলব! একটি গল্প প্রচলিত আছে, কয়েকজন রমণী স্নান করছেন সরোবরে, উলঙ্গ শুকদেব পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন, রমণীরা তাঁকে দেখেও বিচলিত হলেন না। তখন রমণীদের জিজ্ঞাসা করা হল, কেন একজন উলঙ্গ পুরুষকে দেখেও তোমরা লজ্জা পেলে না? তখন রমণীরা উত্তর করলেন, শুকদেব ব্রহ্মজ্ঞানী, তিনি তাঁর মধ্যেও যাঁকে দেখেন, আমাদের মধ্যেও সেই ব্রহ্মকেই দেখেন, তাঁর কাছে স্ত্রী-পুরুষ, জড়-জীব এসব ভিন্নতা নেই, তবে কী কারণে লজ্জা পেতে যাব? আরও মনে রাখা দরকার, শ্রীমদ্ভাগবতের রাসলীলা বর্ণনার ঠিক আগেই এমন দুটি কাহিনি আছে, যাতে দেবরাজ ইন্দ্র ও বরুণের ঐশ্বর্যের দম্ভ চূর্ণ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। গোবর্ধন-ধারণ ও নন্দের মোচন শীর্ষক অধ্যায়গুলি পাঠ করলে তা বোঝা যাবে। এই পরিপ্রেক্ষিতটা বিচার করা এই কারণেই দরকার, কারণ রাস সম্পর্কিত যাবতীয় ঘটনাবলী বা কাহিনি আমাদের বুঝতে হবে ঐহিক অনুষঙ্গের ঊর্ধ্বে উঠে। ‘ভিক্টোরিয়ান মরালিটি’ দ্বারা যেমন এর বিচার সম্ভবপর নয় অপরপক্ষে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য লীলা হিসেবেও এর বিচার করা সম্ভব নয়। রাসমণ্ডলে প্রবেশ করতে হলে বাহ্যেন্দ্রিয় বাঞ্ছা ত্যাগ করে শুদ্ধচিত্তে প্রবেশ করতে হবে। শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হচ্ছে,

কাম, প্রেম, দোঁহাকার বিভিন্ন লক্ষণ।  

লৌহ আর হেম যৈছে স্বরূপ বিলক্ষণ ।

‘আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা’ তারে বলি কাম;

‘কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা’ ধরে প্রেম নাম। ,

 কামের তাৎপৰ্য্য নিজ সম্ভোগ কেবল;

কৃষ্ণ-সুখ তাৎপৰ্য্য মাত্র প্রেমেতে প্রবল।

লোকধৰ্ম্ম, বেদধৰ্ম্ম, দেহধৰ্ম্ম কৰ্ম্ম,

 লজ্জা, ধৈর্য্য, দেহসুখ, আত্মসুখমৰ্ম্ম,

দুস্ত্যজ্য আর্য্য পথ, নিজ পরিজন,

স্বজন করয়ে যত তাড়ন ভর্ৎসন,

সৰ্ব্বত্যাগ করি করে কৃষ্ণের ভজন;

কৃষ্ণ সুখ হেতু করে প্রেমের সেবন। 

এখানেই দেহজ কাম আর অপ্রাকৃত প্রেমের পার্থক্য। সুতরাং ব্রজমণ্ডলে যা সম্ভব, প্রাকৃত দৃষ্টিতে তা সম্ভব নয়। সচ্চিদানন্দ ভগবানের তিনটি অংশ, সৎ, চিৎ, আনন্দ। সৎ অংশের শক্তি হল সন্ধিনী বা জ্ঞান, চিৎ অংশের শক্তি হল সম্বিত বা কর্ম আর আনন্দ অংশের শক্তি হ্লাদিনী বা প্রেম। শ্রীকৃষ্ণের অভিন্ন হ্লাদিনী শক্তি হচ্ছেন রাধা। লৌকিক দৃষ্টিতে বা রসশাস্ত্র অনুসারে শ্রীকৃষ্ণের পরকীয়া নায়িকা হচ্ছেন শ্রীরাধা। শাস্ত্রে এই পরোঢ়াকেই শ্রেষ্ঠ নায়িকা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। “রমাদিভ্যোঽপ্যুরুপ্রেমসৌন্দর্যভরভূষিতা”— অর্থাৎ, পরোঢ়া নায়িকার প্রেম ও সৌন্দর্য বৈকুণ্ঠের বিষ্ণুপত্নী লক্ষ্মীদেবীকেও হার মানায়। বিষ্ণুগুপ্তসংহিতায় বলা হচ্ছে, নিষেধ এবং দুর্লভতাই এই প্রেমকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। যা সহজলভ্য নয়, তার প্রতি জগতের আসক্তি চিরন্তন। যে প্রেমে বাধা থাকে, নায়ক-নায়িকার মিলন যেখানে দুর্লঙ্ঘ্য সেই প্রেমই জগতে বিখ্যাত হয়েছে যুগে যুগে। লৌকিক জগতে পরকীয়ায় দুর্গতি আছে। তাই চৈতন্যচরিতামৃতকার বলছেন,

পরকীয়াভাবে অতি রসের উল্লাস।

ব্রজ বিনা ইহার অন্যত্র নাহি বাস।।

ব্রজবধূগণের এই ভাব নিরবধি।

তার মধ্যে শ্রীরাধায় ভাবে অবধি।।

প্রৌঢ় নির্ম্মল ভাব প্রেম সর্ব্বোত্তম।

কৃষ্ণের মাধুরী আস্বাদনের কারণ।।

অতএব সেই ভাব অঙ্গীকার করি।

সাধিলেন নিজ বাঞ্ছা গৌরাঙ্গ শ্রীহরি।।

হ্যাঁ, পরকীয়া রতি অবশ্যই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু ব্রজ ছাড়া এর অন্যত্র গতি নেই। শ্রীরাধা এখানে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অভিন্ন সত্তায় অবস্থান করেন।

রাধা-কৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি।

অন্যোন্যে বিলাসে রস আস্বাদন করি।।

তন্ত্রের দৃষ্টিও এই, পুরুষ-প্রকৃতি চণকাকার, চণক বা ছোলার যেমন দুইটি বীজপত্র, কিন্তু আদতে এক বীজ, তেমনই পুরুষ ও প্রকৃতি অভিন্ন। তাই শ্রীকৃষ্ণ যে লীলা করেছেন, তা শ্রবণ-পঠন-অনুভবেই এর আনন্দ আস্বাদন করতে হবে। আবার ‘ব্রজ’ অর্থে এখানে ব্রজপ্রেমও হতে পারে। অর্থাৎ যে ব্রজ হতে আগত যে প্রেমে কোনও মোহ নেই, কামনা নেই। সেই ব্রজপ্রেমে যদি কেউ পরকীয়া করে, নিতান্তই প্রেমের তাড়নায়, তবে সমাজ বা আইন সেই পরকীয়াকে স্বীকৃতি দিক বা না দিক, রসশাস্ত্র স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু যদি অতৃপ্ত কামনা, শরীরি মোহ, উদগ্র লালসার বশবর্তী হয়ে কেউ এই রতি কামনা করে তার দুর্যোগ অবশ্যম্ভাবী। শ্রীরাধা স্ত্রীধর্মত্যাগিনী, তবু জগতের শ্রেষ্ঠা প্রেমিকা। তুলনা করার আগে তাঁকে অনুভব করতে হবে। অনুভবই প্রেম, মোহ নয়। তফাতটুকু হৃদয়ঙ্গম হলে আর কোনও আশ্লেষ থাকবে না। শ্রীচৈতন্য সেই রাধার প্রেমকে অঙ্গীকার করলেন। ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ এই পুরুষার্থ চতুষ্টয়কে অতিক্রম করে বললেন, “মোক্ষবাঞ্ছা কৈতব প্রধান।” প্রেমকে করলেন পঞ্চম পুরুষার্থ। রাস বুঝতে হলে এই প্রেমকে বোঝাও দরকার। রাসের মহিমা প্রসঙ্গে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হচ্ছে, রাসের তত্ত্ব অনুধাবন করলে, সেই ব্যক্তি মৃত্যুর পর গোলোকে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের স্বারূপ্য বা পার্ষদপদ লাভ করবে। টীকাকার শ্রীধরস্বামীও এই লীলা শ্রবণে, পঠনে মুক্তির কথাই ঘোষণা করেছেন। শ্রীধরস্বামীর আরও একটি উক্তি এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো। তিনি বলছেন, কন্দর্প অর্থাৎ মদনের খুব গর্ব, যে সে দেবতাদেরও কামবাণে জর্জরিত করতে পারে, কিন্তু রাসমণ্ডলে মদনও পরাস্ত হয়েছেন প্রেমাভক্তির কাছে, শ্রীকৃষ্ণ মদনকেও মোহিত করেছেন, তাই তিনি মদনমোহন।

চড়ি গোপী-মনোরথে,      মন্মথের মন মথে,

নাম ধরে মদন মোহন।

তিনি পঞ্চশর দর্প,        স্বয়ং নবকন্দর্প,

রাস করে লঞা গোপীগণ।।

এ তো গেল প্রেমের কথা, যদি রাসকে উপনিষদ বা বেদাদি শাস্ত্রের দ্বারা বিচার করি, তবেও মাহাত্ম্য কিছু কমে না। প্রথমেই তৈত্তিরীয় উপনিষদের বাক্যটি ধরা যাক, ‘রসো বৈ সঃ’। অর্থাৎ ব্রহ্ম রসময়। এই রস থেকেই রাস। রাস আসলে রসের উৎসব। কেমন সেই রস? রবীন্দ্র রচনাবলী থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করলে বিষয়টি পরিস্ফুট হবে, তাঁর মতো আর কেই বা বোঝাতে পারেন!

“যাঁরা তোমাকে নিখিল আকাশে পরিপূর্ণভাবে দেখেছেন তাঁরা তো কেবল তোমাকে জ্ঞানময় বলে দেখেন নি। কোন্‌ প্রেমের সুগন্ধ বসন্তবাতাসে তাঁদের হৃদয়ের মধ্যে এই বার্তা সঞ্চারিত করেছে যে, তোমার যে বিশ্বব্যাপী অনুভূতি তা রসময় অনুভূতি। বলেছেন ‘রসো বৈ সঃ’-সেইজন্যেই জগৎ জুড়ে এত রূপ, এত রঙ, এত গন্ধ, এত গান, এত সখ্য, এত স্নেহ, এত প্রেম। এতস্যৈবানন্দস্যান্যানিভূতানি মাত্রামুপজীবন্তি। তোমার এই অখন্ড পরমানন্দ রসকেই আমরা সমস্ত জীবজন্তু দিকে দিকে মুহূর্তে মুহূর্তে মাত্রায় মাত্রায় কণায় কণায় পাচ্ছি-দিনে রাত্রে, ঋতুতে ঋতুতে, অন্নে জলে, ফুলে ফলে, দেহে মনে, অন্তরে বাহিরে বিচিত্র করে ভোগ করছি। হে অনির্বচনীয় অনন্ত, তোমাকে রসময় বলে দেখলে সমস্ত চিত্ত একেবারে সকলের নীচে নত হয়ে পড়ে। বহে-দাও দাও, আমাকে তোমার ধূলার মধ্যে তৃণের মধ্যে ছড়িয়ে দাও। দাও আমাকে রিক্ত করে কাঙাল করে, তার পরে দাও আমাকে রসে ভরে দাও। চাই না ধন, চাই না মান, চাই না কারো চেয়ে কিছুমাত্র বড়ো হতে। তোমার যে রস হাটবাজারে কেনবার নয়, রাজভান্ডারে কুলুপ দিয়ে রাখবার নয়, ঘা আপনার অন্তহীন প্রাচুর্যে আপনাকে আর ধরে রাখতে পারছে না, চার দিকে ছড়াছড়ি যাচ্ছে-তোমার যে রসে মাটির উপর ঘাস সবুজ হয়ে আছে, বনের মধ্যে ফুল সুন্দর হয়ে আছে-যে রসে সকল দুঃখ সকল বিরোধ সকল কাড়াকাড়ির মধ্যেও আজও মানুষের ঘরে ঘরে ভালোবাসার অজস্র অমৃতধারা কিছুতেই শুকিয়ে যাচ্ছে না, ফুরিয়ে যাচ্ছে না-মুহূর্তে মুহূর্তে নবীন হয়ে উঠে পিতায়-মাতায় স্বামী-স্ত্রীতে পুত্রে- কন্যায় বন্ধু-বান্ধবে নানা দিকে নানা শাখায় বয়ে যাচ্ছে-সেই তোমার নিখিলে রসের নিবিড় সমষ্টিরূপ যে অমৃত তারই একটু কণা আমার হৃদয়ের মাঝখানটিতে একবার ছুঁইয়ে দাও। তার পর থেকে আমি দিনরাত্রি তোমার সবুজ ঘাসপাতার সঙ্গে আমার প্রাণকে সরস করে মিলিয়ে দিয়ে তোমার পায়ের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে থাকি।”

ঠিক যেন গোপীদের প্রাণের আকুতি ফুটে উঠেছে কবিগুরুর ভাষায়। আগেই উল্লেখ করেছিলাম, রাসমণ্ডলে প্রবেশ করতে গেলে বাহ্যেন্দ্রিয়কে স্তব্ধ করে দিতে হবে। কিন্তু কেমন করে তা সম্ভব? উত্তর দিয়েছে উপনিষদ এবং উত্তর দিয়েছেন কবিগুরু। রসের যে টান, তাই রাসমণ্ডলের দিকে ধাবিত করে। পদকর্তা গোবিন্দদাসের একটি অসাধারণ পদ আছে এই প্রসঙ্গে,

শারদ চন্দ পবন মন্দ

বিপিনে ভরল কুসুমগন্ধ

ফুল্ল মল্লিকা মালতী যূথী

.           মত্ত মধুকর-ভোরণি।

হেরত রাতি ঐছন ভাতি

শ্যাম মোহন মদনে মাতি

মুরলী গান পঞ্চম তান

.           কুলবতী-চিত চোরণি।।

শুনত গোপী প্রেম রোপি

মনহি মনহি আপন সোঁপি

তাঁহি চলত যাঁহি বোলত

.           মুরলীক কলকলনি।

বিসরি গেহ নিজহুঁ দেহ

এক নয়নে কাজররেহ

বাহে রঞ্জিত কঙ্কণ একু

.           এক কুণ্ডল-দোলনি।।

শিথিলছন্দ নীবিক বন্ধ

বেগে ধাওত যুবতিবৃন্দ

খসত বসন রশন চোলি

.           গলিত-বেণী-লোলনি।

ততহি বেলি সখিনী মেলি

কেহু কাহুক পথ না হেরি

ঐছে মিলল গোকুলচন্দ

.           গোবিন্দদাস-বোলনি।।

শরতের প্রফুল্লিত মল্লিকাদি কুসুম দেখে শ্যাম বাঁশিতে ধ্বনি দেওয়া মাত্র প্রেমরূপী গোপীগণ যে-যে অবস্থায় ছিলেন, সেই অবস্থাতেই দেহ-গেহ সব ছেড়ে ছুটে এসেছেন। কারো হাতে একটি কঙ্কণ, এক নয়নে কাজলের লেখা, কারোর বসন খসে যাচ্ছে, কিন্তু হুঁশ নেই, তাঁরা রসের টানে ছুটে এসেছেন। এই হল রসের ধারা। ছান্দোগ্য উপনিষদে আরো বলা হচ্ছে, একোঽহং বহুস্যামঃ! বা ঋগ্বেদের ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তী’! অর্থাৎ এক ব্রহ্ম বহুধা হয়েছেন। কৃষ্ণলীলায় আমরা প্রথম তার আভাস পেলাম দশম স্কন্ধের ত্রয়োদশ অধ্যায়ে। প্রজাপতি ব্রহ্মা যখন ব্রজের সকল গাভী আর রাখালকে সরিয়ে দিলেন, কৃষ্ণ তখন সেই সব গাভী আর গোপালকের রূপ ধরলেন, এবং সবই স্বাভাবিকভাবেই চলল। এক বৎসর পর্যন্ত এই খেলার শেষে ব্রহ্মার সন্দেহ মোচন হল, সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে গেল। একই ভাব আমরা দেখলাম রাসে। এক কৃষ্ণ, বহু কৃষ্ণ হয়ে বহু গোপীর সঙ্গে একই রাসমণ্ডলে আমোদ করলেন। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের হিসেব মানলে এই যুগলের সংখ্যাটি নয় লক্ষ। গুরু গৌরচন্দ্র ও সকল ভক্ত-বৈষ্ণবদের চরণে পুনঃপুন প্রণাম জানিয়ে চলুন আমরা লীলায় প্রবেশ করি।

যোগমায়া কাত্যায়নী কৃষ্ণলীলার সূত্রধারিণী। তিনি লীলাবিস্তারে সহায়তা করেন। যে মহামায়ার লীলায় জীব মোহান্ধ হয়ে জীবাত্মার দর্শন, পরমাত্মার অন্বেষণে মতি হারায়, সেই মহামায়াই বৃন্দাবনী লীলানাট্যে মঞ্চ প্রস্তুত করেন, সূত্রধারিণী হন, যে নাট্যে জীবাত্মারূপী গোপীগণ, পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হবেন। শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের দ্বাবিংশ অধ্যায়ে এই লীলামঞ্চই প্রস্তুত হয়েছে। গোপীগণ কাত্যায়নী ব্রত করলেন। কালিন্দীর তীরে বালুময় মূর্তি গড়ে তাঁরা দশভুজার পূজা করলেন যথাসাধ্য উপাচারে। প্রণাম করলেন এই মন্ত্রে,

ওঁ কাত্যায়নী মহামায়ে মহাযোগিন্যধীশ্বরী।

নন্দগোপসুতং দেবী পতিং মে কুরুতে নমঃ।।

শ্রীকৃষ্ণকে দয়িত রূপে প্রার্থনা করলেন তাঁরা। এই তাঁদের ব্রতের উদ্দেশ্য। আজও বৈষ্ণবগণ কৃষ্ণভক্তি প্রার্থনা করে দশভুজা দুর্গার আরাধনা করেন।

আজু কীবা শোভা হেরি ব্রজের মাঝার।

গোপীগণ আয়োজন করিছে পূজার।।

মৃন্ময়ী মুরতিখানি মা যোগমায়ার।

দশভুজা রুপ হেরি যাই বলিহার।।

এক ঠাঁই করে কেহ চন্দন কুঙ্কুম।

মালিকা গাঁথয়ে দিয়া শতেক কুসুম।।

তুলসী বিল্বের দল শত শতদল।

একত্র করিয়া কেহ অর্ঘ্য সাজায়ল।।

দধি দুগ্ধ ক্ষীর ননী আনে ভাণ্ড ভরি।

ফলমূল লাড়ু দেয় স্তূপাকার করি।।

ঐছে করে গোপীগণ পূজা আয়োজন।

গৌরাঙ্গী আসিল তথা যথা নিধুবন।।

সোনার বরণী গোরী অঙ্গে পটবাস।

সুন্দর তিলক ভালে বদনে সুহাস।।

গলেতে মালিকা কীবা শোভা করে হায়।

উজোর অরুণ যেন নামিলা ধরায়।।

এত করি রাধারাণী আচমন করি।

উপবেশি পূজাস্থলে আসন উপরি।।

আরম্ভ কৈলেন পূজা ভক্তিযুতা হয়্যা।

দেবগণ আসে সবে জয় জয় কয়্যা।।

মহামায়া কাত্যায়নী        গুণভূতা নারায়ণী

মহাযোগিনীর অধীশ্বরী।

গোপরাজ ব্রজেশ্বর        গোপীগণে পতি কর

তব পদে এ মিনতি করি।।

রাগানুগা ভক্তি রতি        জগতে দুর্লভা অতি

সেই রতি মোরে কর দান।

জনম জনম ধরি          সে রতিতে পূজা করি

জিনি যেন কালাচাঁদ প্রাণ।।

শিবের ঘরণী মাগো       সদা মোর হৃদে জাগো

ধরিয়া মঙ্গলময়ী বেশ।

যে প্রেমে শ্মশানচারী তব প্রেমে ভিক্ষাহারী

সেই প্রেম কর উপদেশ।।

আর একদিন স্নান করতে কালিন্দীর জলে নামলেন গোপীগণ। বস্ত্র রইল তীরে। শ্রীকৃষ্ণ ছল করে বস্ত্র হরণ করলেন। কদম্বের গাছে উঠে নানা পরিহাস করে কাতরা গোপিনীদের বললেন, তাঁরা যেন ঐ অবস্থায় উঠে এসে শ্রীকৃষ্ণের কাছে বস্ত্র প্রার্থনা করেন। অনেক কাকুতি মিনতির পর অবশেষে গোপীগণ তাই করলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস বলতেন, “সাধনা করতে গেলে অষ্টপাশমুক্ত হয়ে তবে সাধনা করতে হয়। কাঁধে পৈতেগাছটিও রাখতে নেই, পাছে আমি বর্ণশ্রেষ্ঠ এই অভিমান আসে!” অষ্টপাশ হল, ঘৃণা, লজ্জা, মান, অপমান, মোহ, দম্ভ, দ্বেষ আর খলতা। ভগবান গোপীদের সকল পাশ দূর করে আশ্বাস দিলেন, আগামিনী যামিনীসকলে আমি তোমাদের সঙ্গে বিহার করব। এই হল রাসের প্রেক্ষাপট। আগামীতে অপেক্ষা করছে আরও নাটকীয়তা।

ভগবানপি তা রাত্রীঃ শারদোৎফুল্লমল্লিকাঃ।

বীক্ষ্য রন্তুং মনশ্চক্রে যোগমায়ামুপাশ্রিতঃ।

ভগবানের সংজ্ঞায় গীতাভাষ্যে আদিগুরু শংকরাচার্য লিখছেন, ‘স চ ভগবান জ্ঞানৈশ্বর্যশক্তিবলবীর্যতেজোভিঃ সদা সম্পন্নঃ’। জ্ঞান, ঐশ্বর্য, শক্তি, বল, বীর্য, তেজ এই হচ্ছে ভগবানের ষড়ৈশ্বর্য। তিনি ষড়ৈশ্বর্যসম্পন্ন হয়েও যোগমায়াকে আশ্রয় করলেন। প্রফুল্লিত মল্লিকাদি কুসুম দেখে তিনি বিহার করতে ইচ্ছা করলেন। শ্রীশ্রীচণ্ডীর মধুকৈটভবধের সময় দেখা যাচ্ছে, ব্রহ্মার স্তবে ভগবতী যোগমায়া যোগনিদ্রাগত শ্রীবিষ্ণুর বক্ষ, বাহু থেকে নিষ্ক্রান্তা হয়ে তাঁকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করছেন। এখানেও তাই। বিশ্বচরাচরের যত লীলা, মহামায়ার প্রভাব ছাড়া সব শূন্য। এই জগতকাণ্ডে তাঁর আবরণ আছে বলেই আমরা রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের অনুভূতি পাই। বিরাট ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি, স্থিতি, লয় তাঁরই ইচ্ছানুসার। তাই সেই ভগবতীকেই আশ্রয় করলেন শ্রীকৃষ্ণ, নিজের অতুল ঐশ্বর্যও রাসমণ্ডলে গোপন করলেন। ভগবান নিজমুখে বলেছেন, “নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়া-সমাবৃতঃ।” তিনি যোগমায়ায় আবৃত থাকেন বলেই তাঁর স্বরূপ অগোচর থাকে। কাম ও প্রেমের যে খেলা জীবের স্বভাবধর্ম, তাতে নিজেরই হ্লাদিনীশক্তির সঙ্গে বিহার করে নিজানন্দেই শ্রীকৃষ্ণ ভেসে যেতে চান। জীবের আপন অন্তরের আনন্দশক্তি মহামায়ার প্রভাবেই অনাবিষ্কৃত থাকে, মহামায়াকে আশ্রয় করলেই তা প্রকট হয়।

     নির্মল আকাশে পূর্ণচন্দ্রের উদয় হল। শ্রীকৃষ্ণ বংশীতে পঞ্চম তান ধরলেন। বংশীরব আকর্ষণে উদ্দীপিতা গোপীগণ সমস্ত ছেড়ে বংশীধ্বনির উৎসমুখে ধাবিত হলেন। যে যে কার্যে ব্যাপৃত ছিলেন, সে সকল ফেলে ছুটে আসলেন কৃষ্ণের টানে। যাঁদের সংসারের প্রতি কিঞ্চিৎ মায়াও অবশিষ্ট ছিল, তাঁরা আপন গৃহেই কৃষ্ণের ধ্যান করতে লাগলেন। তাঁরাও শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সম্বন্ধিত থাকার সুবাদে জীবন্মুক্ত হয়ে গেলেন।

     যাঁরা এলেন তাঁদের কৃষ্ণ সম্ভাষণ করে জিজ্ঞেস করলেন, এই রাত্রে তোমাদের এখানে আগমনের হেতু কী! ছলনা করে বললেন, ঘরে তোমাদের পতি-পুত্রাদি আছে, এই গহীন বনে, এই ভয়ংকর রাত্রিতে এখানে একজন পরপুরুষের সঙ্গে তোমাদের থাকা শোভা পায় না মোটেই, তোমাদের নিন্দা হবে লোকসমাজে, তোমরা বরং ফিরে যাও। এই সব শুনে গোপীগণ যেন বজ্রাহত হলেন, পদনখে ধরণী বিদীর্ণ করতে করতে তাঁরা বললেন, তবে বাঁশি বাজালে যে বড়ো! কেন ডাকলে অমন করে! আমরা সর্বস্ব ত্যাগ করে তোমার জন্য ছুটে এসেছি, এখন তুমি যদি নিষ্ঠুর হয়ে আমাদের ফিরিয়ে দাও, তবে আত্মহনন ছাড়া আর উপায় থাকবে না। পতি-পুত্রের যত্ন স্ত্রীজাতির ধর্ম, এটা সত্যি, তবে ভগবানের প্রতি প্রেম কি সত্য নয়? ‘তস্মিন্ তুষ্টে জগত তুষ্টম্’ এ বাক্যও তবে সত্যি নয়? গোপীগণ নানা বাক্যে জর্জরিত করে শ্রীকৃষ্ণকে সখা সম্বোধন করে অধরপল্লব এবং করকমলদ্বয় তাঁদের মস্তকে ও উত্তপ্ত হৃদয়ে কামনা করলেন। রসের কেমন ধারা! একই সঙ্গে সখ্য, মধুর এবং দাস্যভাব কেমন প্রকট হয়ে উঠল।

     গলায় বনমালা দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ অদ্ভুত মনোহর বেশ ধারণ করে অবশেষে গোপীদের নিয়ে নদীতীরে ভ্রমণে গেলেন। বনময় আলো ঝলমল করে উঠল। গোপীরা গানে গানে ভরিয়ে দিলেন চারিধার। কৃষ্ণও তাঁদের সঙ্গে গলা মেলালেন। গোপীদের কাউকে আলিঙ্গন, কাউকে চুম্বন, কাউকে হাসি আর মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে রাখলেন। যখনই কৃষ্ণসঙ্গমে মিলে গেলেন গোপীরা, তখনই গোপীগণ নিজেদের জগতশ্রেষ্ঠ নায়িকা মনে করতে শুরু করলেন। সামাজিক জগতেও হেন ঘটনা ঘটেই থাকে। এই মদ রিপু এবং মান জন্মানোয় চূড়ান্ত নাটকীয়তার সঙ্গে ছলনাময় শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হলেন।

শরতের চাঁদ আজি অতি মনোলোভা।

মালতী মল্লিকা তাহে ঘন করে শোভা।।

মধুলোভা ভৃঙ্গ যত মত্ত আলাপনে।

যমুনার নবজল কলকল ভণে।।

মধুবায়ু বহে তায় দশদিশ ভরি।

হেন রম্য ব্রজধাম ঈহা ইহে মরি।।

আজু প্রেম রসরঙ্গ আস্বাদন হেতু।

প্রভু যোগমায়া সনে নিরমানে সেতু।।

বংশী ধ্বনিল রাগে পুরিয়া কল্যাণ।

তাহা শুনি গোপী সব বিসরিতা আন।।

কেহ বা আপনকর্মে আছিল মজিয়া।

ধ্বনি শুনি ছুটি চলে সকলে তেজিয়া।।

সাধনসিদ্ধার গণ গোপীর মণ্ডল।

পঁহুছিল তথা সবে যথা রাসস্থল।।

সহস্র শুকতি যেন ব্রজনদী মাঝে।

তারি মাঝে শ্যাম যেন মোতিসম রাজে।।

সকলেই নিজহৃদে কৃষ্ণমোতি হেরি।

অভিমান জনমিল মনমতি ঘেরি।।

গোপীগণ মনে দর্প হেরি ভগবান।

রাসস্থল হতে ত্বরা হন অন্তর্ধান।।

কালীদাস কবিমন পঞ্চমের দাস।

তাইতে নিদয় কান ত্যাজিলেন রাস।।

গোপীগণ আবারও কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তাঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে কৃষ্ণকে খুঁজতে লাগলেন আর কেঁদে কেঁদে বিলাপ করতে লাগলেন। তাঁদের এই বিরহগীতি ‘গোপীগীত’ নামে জগতে সুখ্যাত।

শুনো শুনো প্রিয়সখা তোমারি কারণে।

বৈকুণ্ঠের

লক্ষ্মীদেবী বসে বৃন্দাবনে।।

মোরা

যত ব্রজগোপী জন্মিনু হেথায়।

গোপীদেহ

পাইনু সে তোমারি কৃপায়।।

শরতের

জলাশয়ে কমলের সম।

নয়নযুগল

ভাতি অতি অনুপম।।

কৃপা

করি দেহো সেই চাঁদছটা দান।

শীতল

করিয়া লই দগধ পরান।।

কালিয়

দলন কর ইন্দ্রের দমন।

উদ্ধারিছ

ব্রজবাসী বিপদভঞ্জন।।

জগত

উদ্ধার হেতু তব আগমন।

নহ

তুমি কেবল হে যশোদানন্দন।

সংসারের

পাঁকে মজে যে মাগে চরণ।

তারে

দেহো তুমি নাথ অভয় শরণ।।

দুহুঁ

কর মাথে রাখো মোরা তব দাসী।

কৃপা

করি কর মোরে চরণ বিলাসী।।

ব্রজবাসীগণে

তুহুঁ বিপদতারণ।

মৃদুমদ

হাসে করো মদ নিবারণ।।

তব

পদে মোরা এই লহিনু শরণ।

কৃপাতে

করাও তব আনন দর্শন।।

যে

পদ কালিয়শিরে করল নাচন।

সেই

পদ এই হৃদে করহ স্থাপন।।

কামনা

বাসনা তাপে অঙ্গার হৃদয়।

পরশে

শীতল করো নাশো দুখভয়।।

যোগী

জ্ঞানী সব ত্যাজে বচন লাগিয়া।

সে

বচন পানে মোর তৃষিত এ হিয়া।

লীলাকথা

তব যেন অমৃত সমান।

গাহিয়া

না পাই অন্ত তব গুণগান।।

যার

কণ্ঠে তব কথা সেই বড় ধনী।

শ্রেষ্ঠ

গোপী তারে কহি মানয়ে অবনী।।

কর্দম

কালিমা মাখা মলিন যে কেহ।

যমুনার

পূত বারি শুদ্ধ করে দেহ।।

সেই

মতো মোরা করি চরণ চিন্তন।

অচিরে

পাইলাম সেই বিশুদ্ধ মনন।।

কোমল

কমল-সম তোমার চরণ।

সেইপদ

ইচ্ছি মোরা করিতে যতন।।

গোচারণ

হতে ফেরো ধূলায় ধূসর।

সেই

রূপ কীরূপেতে করিব পাসর।।

মুরলী

বাদনে ভেল অথির অন্তর।

বনে

কর আনয়ন গেহ করি পর।।

হেন

বেণু লয়্যা কানু লুকাইলা কই।

না

শুনালে সেই ধ্বনি পরাণ তেজই।।

জীবন

মরণ সব তুঁহু শ্যামরায়।

তোমা

বিনা কোন হেতু রাখিতে তাহায়।।

যদি

শ্যাম মনে জাগে গোপী প্রতি প্রীতি।

কালীদাস

কবি তাই গায় গোপীগীতি।।

শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধানে গোপীগণ এতই কাতরা হয়ে পড়েছিলেন যে নিজেদেরই কৃষ্ণ মনে করতে শুরু করেছিলেন এবং তাঁর সব নকল করতে শুরু করেছিলেন। এতেই বোধহয় কাজ হল। প্রথমত, শাস্ত্রে বলে, ‘দেবং ভূত্বা দেবং যজেৎ’, দেবতা হয়ে দেবতার পূজা করতে হয়। আর দ্বিতীয়ত, বিরহ ও অশ্রুজলে তাঁদের অন্তরের মালিন্য সকল দূর হয়ে গিয়েছিল। তাই শ্রীকৃষ্ণের আবার নাটকীয় প্রবেশ হল। গোপীগণ আনন্দে আকুল হয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন, আদর করলেন। শারদীয় মধুর রাত্রিতে রাসহাটে শত শত গোপী যৌবন পসরা সাজিয়ে রাখলেন, গ্রাহক হলেন স্বয়ং মদনমোহন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, তোমাদের ছেড়ে গিয়েও আমি তোমাদেরই ভজনা করেছি, যাতে তোমাদের নিজেদের সুশীলতা দ্বারা পুনরায় আমাকেই লাভ করতে পারো।

     সকল ক্লেষ, সন্তাপ দূরীভূত হলে শুরু হল মহারাস। লীলাক্রমে যত গোপী তত কৃষ্ণ হয়ে সকলে আনন্দ করতে লাগল। স্বর্গ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল। দেব-দেবীগণ বিমানে চড়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলেন। বলয়, নূপুর, কিঙ্কিণীর তুমুল ধ্বনি হল। সস্ত্রীক গন্ধর্বগণ গান করতে লাগলেন। কৃষ্ণকে ঘিরে গোপিনীরা নাচ করছেন। কেউ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যুগলবন্দী করে উচ্চৈস্বরে রাগের আলাপ করছেন। আবার শ্রান্ত গোপীদেহের স্বেদবিন্দু মদনমোহন আপন হাতে মুছিয়ে দিলেন। অধরে অধর রেখে তাম্বুল খাওয়ালেন। নৃত্যের প্রতিযোগিতাও হয়েছিল, শ্যাম বাজী রেখেছিলেন বাঁশি, যদি রাধা বাঁশির সুরে, তালে নাচতে পারেন। শ্যামের বাঁশি খোয়া গেল। গোপীগণ বাজী রাখলেন নিজেদেরই, যদি রাধার নূপুরের তালে শ্রীকৃষ্ণ নাচতে পারেন। গোপীগণও হারলেন অবশ্য। বনের ময়ূর-ময়ূরীও নেচে উঠল। ভ্রমর-ভ্রমরী গান গেয়ে উঠল। আর শ্যাম গোপীদের নিয়ে কালিন্দীর জলে গজের ন্যায় জলক্রীড়া করলেন। সমস্ত রাত্রি এইরূপ প্রেম-আনন্দ-রসে ভেসে কেলি করলেন মদনমোহন।

আজু কীবা শোভা যমুনা তীরে।

সারি সারি রাজে সুরমণীরে।

মধ্যে রাজে কানু মুরলীধর।

ত্রিভঙ্গ বঙ্কিম শ্যামসুন্দর।।

গগনে চন্দ্রমা শীতল অতি।

কিরণ ঢালয়ে স্তবধ গতি।

যমুনা তরঙ্গে উছলে বারি।

মৃদুল অনিলে ত্রিতাপ হারি।।

বন উপবন সুন্দর সাজে।

বিহগ-বিহগী পঞ্চমে গাজে।

শিখীযুগে নাচে কলাপ মেলি।

আর যত প্রাণী করত কেলি।।

ঐঁছন সুন্দর মধুর রাতি।

মধুর লগন অমৃতভাতি।

বসন-ভূষণ ঝলকে তায়।

তারকা উজলে চাঁদের গায়।।

———————————

শ্রীরাসমন্ডলী মাঝে আবেশ সঘন।

রমণী লইয়া নাচে মদনমোহন।।

কেহ বা বাদয়ে বীণা কেহবা মৃদঙ্গ।

কেহ নাচে শ্যামসনে করি বহু রঙ্গ।।

কভু বা নাচেন শ্যাম কভু বা শ্রীরাধা।

শ্যাম নাচে আধ পদ সখী নাচে আধা।।

রাধারে নাচায়ে কভু শ্যাম বাঁশি হারে।

আপনি নাচয়ে কভু মতিমাল কাড়ে।।

এক শ্যাম বহু রূপ সব গোপী মাঝে।

প্রতি গোপী প্রতি শ্যাম এমত বিরাজে।।

দেবগণ আনন্দিত রাসনৃত্য হেরি।

দেবীগণে লয়া নাচে রাসস্থল বেড়ি।।

রসময় রসিকের আনন্দ প্রকাশ।

হ্লাদিনী সহিতে করে মধুর বিলাস।।

কুবলয় শ্যাম যদি রাই ধরে ফণী।

কালীদাস কবি হৃদে নাচ গুণমণি।।

রহস্যের শেষ কি হল? না, হয় নাই। প্রভাতে শ্যামের আজ্ঞায় গোপীগণ ফিরে গেলেন। কিন্তু সারারাত যে তাঁরা বাইরে ছিলেন, কেউ খোঁজ করল না তো! আবার, একোঽহং বহুস্যামঃ! প্রত্যেক পতির কাছেই তাঁদের স্ত্রী শায়িত ছিলেন। বাকি সব মায়া!

ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপ, শান্তিপুর, কোচবিহার, বা মণিপুর, বৃন্দাবনেও সাড়ম্বরে তিনদিনব্যাপী মহারাস পালিত হয়। কাশীতে এইদিন পালিত হয় দেবদীপাবলি। আলোর মালায় সেজে গঙ্গার তীর, মন্দির সব। চন্দ্র কৃত্তিকা নক্ষত্রে প্রবেশ করলেই শুভযোগে কার্তিক স্নান হয়। ঐতিহ্য বহু স্থানেই আজও অক্ষুণ্ন আছে। এই পূর্ণিমাতেই শিখধর্ম প্রবর্তক গুরু নানকের জন্মতিথি। জৈনরাও আদিনাথের অর্চনা করে দীপ জ্বালিয়ে। সবমিলিয়ে সাধকের জন্য মহারাসের যোগ অতি তাৎপর্যপূর্ণ। শুদ্ধ জীবাত্মার সঙ্গে চৈতন্যময় পরমাত্মার রমণ ঘটে। এটা অবিশ্যি পোস্ট-কলোনিয়ালিজম অনুযায়ী অশ্লীল কিনা বলতে পারি না! তবে আজও শুনি নিধুবনে এমন মায়া হয়। বলয়া, নূপুরের ধ্বনি ভেসে আসে বন থেকে! কে লীলা করে কে জানে! অনেক মিথ ছড়িয়ে আছে এসব নিয়ে। লীলাময়ের লীলা বোঝা দায়!

অদ্যাপিহ সেই লীলা করে গোরা রায়,

কোনো কোনো ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।

Subhadeep Saha

Subhadeep Saha is a Kolkata based freelance writer and commentator. He is an associate of The Saborno Sangrahalay - an evolving India studies resource centre in Kolkata.

0 Reviews

Related post