ভ্রাতৃদ্বিতীয়া

 ভ্রাতৃদ্বিতীয়া

“ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা

যম-দুয়ারে পড়ল কাঁটা।

যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা

আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।”

কার্তিকের শুক্ল দ্বিতীয়া তিথিতে বাংলা তথা ভারতের ঘরে ঘরে পালিত হয় ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা। বোনেরা ভাইয়ের কপালে চন্দন বা দইয়ের ফোঁটা দিয়ে মিষ্টিমুখ করায়। ধান-দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করা হয়। উলু, শঙ্খ প্রভৃতি মঙ্গলধ্বনিতে মুখরিত হয়ে থাকে ঘর। উপহার দেওয়া-নেওয়া চলে। ভাই-বোন উভয়েই উভয়ের মঙ্গলকামনা করে। নিত্যদিনের পারিবারিক সম্পর্ক থেকে এভাবেই প্রতিবছর বেড়ে ওঠে স্নেহ, ভালোবাসা। একঘেয়ে জীবনে ফিরে আসে নতুন উচ্ছ্বাস।

    যম মৃত্যুর দেবতা। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ চেয়ে এসেছে কীভাবে প্রিয় মানুষকে মৃত্যুর কাছ থেকে দূরে রাখা যায়। মা সন্তানের দীর্ঘায়ু কামনা করে নীলের ব্রত করেন, স্ত্রী স্বামীর দীর্ঘায়ুর জন্য শিবরাত্রির ব্রত করেন, তেমনই বোন ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে কপালে মাঙ্গলিক ফোঁটা দিয়ে দেয়—যম-দুয়ারে পড়ল কাঁটা। সাবিত্রী-সত্যবানের কাহিনী বা বেহুলা-লক্ষীন্দরের কাহিনি তো জানাই আছে আমাদের সবার। যমলোক থেকে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার কাহিনি। ভারতীয় উপমহাদেশে পুরুষের আয়ু স্ত্রী-র আয়ুর চাইতে কম তাই হয়তো এই জাতীয় লৌকিকতার সৃষ্টি হয়েছে। ভাইফোঁটাও এই জাতীয় লৌকিক আচার।

    ভাইফোঁটা লৌকিক আচার বটে, তবে তার কিছু পৌরাণিক ও মহাকাব্যিক সূত্রও রয়েছে। কথিত আছে নরকাসুর বধের পর ক্ষুধার্ত শ্রীকৃষ্ণকে সুভদ্রা ভোজন করিয়ে বিজয়তিলক পরিয়ে দিয়েছিলেন। যম ও যমুনা সূর্য ও ঊষার যমজ সন্তান। লোকমুখে কথিত হয়, যম এই দিনে যমুনাকে ফোঁটা দিয়েছিলেন। কিন্তু এই আপাতসুন্দর লোকশ্রুতির মধ্যেই জড়িয়ে আছে ভাই-বোনের পবিত্র সম্পর্কের রহস্য। ঋগ্বেদের সংহিতা অংশে যম ও যমুনার মধ্যে একটি কথোপকথন গ্রন্থিত রয়েছে। তাতে দেখা গেছে, যমী অর্থাৎ যমুনা এক নির্জন দ্বীপে যমের সংসর্গ কামনা করেছেন। আমরা অনেকেই জানি, প্রাচীন যুগে ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহরীতি দেখা যেত। এখনও কিছু কিছু উপজাতির মধ্যে এই ধারা রয়েছে। যম কিন্তু এই পথ দেখাননি। যম বোন যমুনাকে যুক্তির মাধ্যমে শান্ত করে বুঝিয়েছেন এই পবিত্র সম্পর্কের কথা। শারীরিক চাহিদার ঊর্ধ্বে যে সকল সম্পর্ক, তার মধ্যে একটি ভাইবোনের সম্পর্ক। যমুনাকে নিরস্ত করে যম এই বৈদিক অনুশাসনের পরম্পরাটি প্রতিষ্ঠা করে গেছিলেন, যাতে ভাবী সমাজ ভুল পথে চালিত না হয়। সুতরাং সামাজিক দিক থেকে এই দিনের সঙ্গে যম-যমুনার একটি সম্পর্ক থেকেই যায়। আর প্রথম কারণ তো আছেই, যমের দুয়ারে কাঁটা। .

    স্মৃতিশাস্ত্রে বলা হচ্ছে—

কার্তিকে শুক্লপক্ষস্য দ্বিতীয়ায়াং যুধিষ্ঠির।

যমো যমুনয়া পূর্বং ভোজিতঃ স্বগৃহেঽর্চিতঃ।।

অতো যমদ্বিতীয়েয়ং ত্রিষু লোকেষু বিশ্রুতা।

অস্যাং নিজগৃহে বিপ্র ন ভোক্তব্যং ততো নরৈঃ।।

স্নেহেন ভগিনীহস্তাৎ ভোক্তব্যং পুষ্টিবর্ধনম্।

দানানি চ প্রদেয়ানি ভগিনীভ্যো বিধানতঃ।।

স্বর্ণালংকারবস্ত্রান্নপূজাসৎকারভোজনৈঃ।

সর্বা ভগিন্যঃ সম্পূজ্যা অভাবে প্রতিপন্নকাঃ।।

বলা হচ্ছে এই যমদ্বিতীয়ায় ভগিনীর হাতে স্নেহযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে পুষ্টিবর্ধন হয়। তবে উপহারের তালিকায় সোনার অলংকারও রয়েছে! শাস্ত্রবিধি মানলে ভাইদের দুর্গতির সীমা থাকবে না দেখা যাচ্ছে। যদিও যম-দুয়ারে কাঁটা তো পড়বেই। 

Ganesh Thakur

0 Reviews

Related post