বিবেক-দীপিকা

 বিবেক-দীপিকা

প্রস্তাবনা

“বিবেকিনাং বিবেকায় বিমর্শায় বিমর্শিনাম্।

প্রকাশিনাং প্রকাশায় জ্ঞানিনাং জ্ঞানরূপিণে।।”

সনাতন বৈদিক ধর্মে গুরুতত্ত্ব এক অদ্ভুত আধ্যাত্মিক প্রকাশ। জ্ঞানসন্ধিৎসুর কাছে জ্ঞানরূপে, তত্ত্ব বিচারকারীর কাছে বিচাররূপে, প্রকাশকারীর কাছে প্রকাশরূপে গুরু প্রতিভাত হন। আর বিবেকীর কাছে স্বয়ং বিবেকরূপে। ভারতীয় অধ্যাত্ম ইতিহাসে প্লাবন এনেছিল শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবধারা। সমকালীন প্রেক্ষাপটে দৃকপাত করলে আমরা দেখতে পাব, সনাতন ধর্মে ও সমাজে তখন পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকারে ছেয়ে ছিল। সেই অন্ধকার থেকে যুগধর্মের আলোক বিচ্ছুরিত হয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের ফলে। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের এই আলোক বয়ে আনল কে? কাকে শ্রীরামকৃষ্ণ দিলেন তাঁর আধ্যাত্মিক সম্পদ? শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, সপ্তর্ষিমণ্ডল থেকে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন কার্য উদ্ধারের জন্য। আর কাশীপুর উদ্যান বাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণ যখন শেষ শয্যায়, একদিন এক টুকরো কাগজে কম্পিত হস্তাক্ষরে হুকুমনামা লিখে দিলেন, ‘নরেন শিক্ষে দিবে!’ এই ছোট্ট কাগজটির মূল্য বুঝতে গেলে দেখতে হবে, ‘নরেন’ কী করল এর পর। ওই এক হুকুমে দেশবিদেশ তোলপাড় করে ফেলা উনচল্লিশ বছরের মানুষটিকে বুঝতে গেলে উনচল্লিশটি মানবজন্মও বুঝি শেষ হয়ে যাবে! আমরা নিতান্তই অবোধ, তাঁকে বোঝার বোধ আমাদের নেই, আমরা শুধু পারি তাঁর কর্মগুলিকে চর্চার পরিমণ্ডলে এনে নিষ্ফল আলোচনা করতে, তাতে যদি আমাদের ধীশক্তির কিঞ্চিৎ উন্নতি হয়! কারণ মানুষটির নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে নিলে, তিনি স্বামী বিবেকানন্দ আর প্রেমাদরে তাঁকে ডাকলে, তিনি আমাদের ‘বিলে’, বাংলার ‘বিলে’।

শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ—অনবিচ্ছিন্ন পরম্পরা

       ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি, উত্তর কলকাতার সিমলা অঞ্চলে বিশ্বনাথ দত্ত ও ভুবনেশ্বরী দেবীর ঘরে জন্ম হয় নরেন্দ্রনাথ দত্তের। ছোটবেলা থেকেই মেধায় তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে অধ্যাত্মচেতনার বীজ বপন হয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ আলোকে ও শক্তিসিঞ্চনে তা অঙ্কুরিত ও ক্রমে বৃক্ষে পরিণত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণসান্নিধ্যে থেকে তিনি হয়ে ওঠেন জ্যোতির্ময় এক পুরুষ। ১৮৮১ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান নরেন্দ্রনাথের জিজ্ঞাসু মনের পিপাসা মেটান শ্রীরামকৃষ্ণ। নরেন্দ্রনাথকে নির্বিকল্প সমাধির স্বাদ অনুভব করান। সাধনার মাধ্যমে নরেন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক জীবনের সর্বোচ্চ অনুভব অনুভূত হয়। ‘জীবসেবাই শিবসেবা’ এই মহামন্ত্রও শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রনাথকে দিয়ে গেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার পর থেকে সাধন-ভজন-বিচারে অদূরবর্তী আন্দোলনের জন্য নরেন্দ্রনাথ প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কঠোর তপশ্চর্যা, গুরুর সেবা, শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন, আলোচনা, জীবসেবা এভাবেই ভাবীকালের বিবেকানন্দের যাত্রাশুরু। শেষ জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণ সন্ন্যাসের তত্ত্ব, গৈরিক বস্ত্র দান করেন নরেন্দ্রনাথ সহ অন্যান্য গুরুভাইদের। হুকুমনামাও দাখিল হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের অপ্রাকট্যের পর শুরু হয় তীব্র লড়াই। আঁটপুরে গুরুভ্রাতা বাবুরামের বাড়িতে ধুনির আগুন ছুঁয়ে শপথ করেন সবাই, মঠ ও মিশনের মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণ আদিষ্ট কর্ম সম্পাদন করবেন তাঁরা। বরাহনগরে একটি পোড়ো বাড়িতে তাঁরা আনুষ্ঠানিক সন্ন্যাস নিয়ে মঠজীবন শুরু করেন। একবেলা আধপেটা খেয়ে, কৌপীনমাত্র সার করে, বাড়িঘর ছেড়ে তাঁরা দিনের পর দিন ওই ভাঙা বাড়িতে কাটান। কাশীপুর মহাশ্মশানে সারারাত জপধ্যানে কাটাতেন। নরেন্দ্রনাথ চাইলে জীবনে কোন ঐশ্বর্যটা না পেতে পারতেন! উচ্চশিক্ষিত, অদ্বিতীয় মেধাবী, শ্রুতিধর, সংগীতজ্ঞ, দার্শনিক, সাহিত্যিক, এক আধারে কোটিগুণের আধার এক তরুণ, তিনি চাইলেই ঐহিক জীবনের সমস্ত সুখ পেতে পারতেন। কিসের তাড়নায় তবে এই কঠোর জীবন বেছে নেওয়া? মানুষের জন্য, স্বধর্মের জন্য, গুরুর কাজের জন্য। আজ তাঁর এই উজ্জ্বল ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কখনও তাঁর এই জীবনটা আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি কখনও! শ্রীরামকৃষ্ণ আর বিবেকানন্দ একে অন্যের পরিপূরক। তিনি বিবেকানন্দকে দিয়েছেন জীবসেবার ভার, যুগধর্মের ভার, সনাতনী অদ্বৈত বেদান্ত প্রচারের ভার। এই ভার বয়েও স্বামী বিবেকানন্দ পরবর্তীতে বিনতভাবে বলেছেন, শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপাকটাক্ষে লক্ষ নরেন্দ্রনাথ তৈরি হতে পারত! এমনই তাঁর গুরুভক্তি। কিন্তু আমরা জানি স্বামী বিবেকানন্দ লক্ষে নয়, কোটিতে নয়, অনন্তে একজনই। তাই তিনি স্বামীজি, শাশ্বত ভারতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

বিশ্বজয়ী বিবেকানন্দ

ভারতবর্ষের একদম দক্ষিণ প্রান্তে, কন্যাকুমারিকা দ্বীপে বসে ধ্যানের দৃষ্টিতে তিনি ভারতাত্মার দর্শন করেছিলেন। ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষ কেমনভাবে জীবন কাটাচ্ছে, সব যেন চোখের সমানে দেখতে পেলে তিনি। তারপর, আশু কর্তব্য স্থির করে বহু বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে, বিদেশের রাস্তায় অর্ধাহারে, অনাহারে কাটিয়ে ১৮৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিকাগোতে আয়োজিত বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় যোগদান করেন স্বামীজি। হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে অসাম্প্রদায়িক, ভেদাভেদরহিত, পরধর্মসহিষ্ণু, উদার হিন্দুধর্মকে তুলে ধরেন তিনি। সনাতন ধর্মের মূল আদর্শকে বিশ্বের দরবারে তিনি শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। বিদেশের প্রচুর মানুষ হিন্দুধর্মের ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে, এই তরুণ সন্ন্যাসীর তেজস্বিতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গ নেন। বহু জায়গায় বক্তৃতা ও প্রচার সেরে তিনি দেশে ফিরে আসেন। পরে আসেন মার্গারেট, ব্রহ্মচারিণী ভগিনী নিবেদিতা। বহু মানুষের আনুকূল্যে কেনা হয় বেলুড় মঠের জমি। মঠ প্রতিষ্ঠা হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের স্বপ্ন সাকার হতে থাকে। স্বামীজীর অনুপ্রেরণায় ভগিনী নিবেদিতা ঝাঁপিয়ে পড়েন কলকাতার প্লেগ মহামারীর কাজে। বাংলার অনেক স্বনামধন্য হিন্দু মহাপুরুষরা যখন পালাচ্ছেন কলকাতা ছেড়ে, তখন বিদেশিনী এক মহিলা রাস্তার জঞ্জাল সাফ করে মহামারীকে জয় করতে চেষ্টা করে চলেছেন। এতটাই দীপ্ত ছিল এই তরুণ সন্ন্যাসীর আবেদন। শুধু মহামারী নয়, নারীশিক্ষাতেও ভগিনী নিবেদিতার অবদান ছিল। স্বামীজি বলেছিলেন, যেদিন ভারতবর্ষের নারীরা শিক্ষিত হবে, সেইদিন ভারত শিক্ষিত হবে। সেই আদর্শ ও শ্রীশ্রীমা সারদা দেবীর আশীর্বাদে ও উৎসাহে ভগিনী নিবেদিতা বাংলার মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করেন, নানান কারিগরি বিদ্যায় প্রশিক্ষিত করে স্বনির্ভর করে তোলার চেষ্টা করেন। শুধু বাংলা নয়, অন্যান্য রাজ্যের মেয়েরাও এই বিদ্যালয়ে আসত। বাল্যবিবাহাদি সহ হিন্দুসমাজের যে সমস্ত অপসংস্কৃতি ছিল, তার বিরুদ্ধে সবসময় রুখে দাঁড়িয়েছেন তিনি। অস্পৃশ্যতা, ভেদাভেদ থেকে সনাতন ধর্মের মূল কাঠামোটাকেই তিনি সামনে আনতে চাইতেন। বেলুড় মঠের পাশাপাশি ভারতের বাইরেও নানান দেশে আজ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের শাখাপ্রশাখা পল্লবিত হয়েছে। আজও সেখানে প্রবাসী ভারতীয় এবং বিদেশিরাও সনাতন ভাবধারায় পুষ্ট হয়ে চলেছেন। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ভালো যা কিছু তা গ্রহণ করে ভারতীয় জনসমাজে এক নবজাগরণের বাণী উচ্চারণ করে গেছেন তিনি। কর্মযোগের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার চরম সীমায় পৌঁছানো যায়, এতে ব্যাষ্টি ও সমষ্টি, সকলেরই আত্যন্তিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে, এ-কথা তিনি বললে, আর কে বলতেন!

অদ্বৈত বেদান্তের প্রচারণা

       আচার্য শংকর ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য লিখেছেন। দেশব্যাপী ঘুরে অদ্বৈততত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। আবার তিনি নিজেই ভবানীর স্তুতি করছেন। সেটিও অদ্বৈততত্ত্বই প্রকাশ করছে। শ্রীরামকৃষ্ণও কালী বিগ্রহে পূজা করছেন, কিন্তু বলছেন, ওই বিগ্রহ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে চৈতন্যময় অদ্বৈতসত্তার সন্ধান করতে। নিঃসন্দেহে জটিল ব্যাপার। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত পাঠ করলে বোঝা যায়, সেটি বেদান্তের সার ভিন্ন কিছু নয়। স্বামী বিবেকানন্দ সেই বেদান্তেরই প্রচার করেছেন। বেদান্ত এমন একটি বিষয়, যার দ্বারা জগতের সকল সমস্যার সমাধান করা যায়। সাধারণ মানুষের চরিত্র গঠনের পর ক্রমে ক্রমে জীব থেকে শিব হওয়ার যে উত্তরণের কথা স্বামীজি বলছেন, সেই উত্তরণই সনাতন ধর্মের উত্তরণ। শংকর প্রচারিত অদ্বৈতভাবনা বা রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈত ভাবনা এবং আরও বহু মতের সমন্বয়ে তৈরি এই বেদান্ত মত। শ্রীরামকৃষ্ণই যুগপ্রয়োজনে এই সমন্বয়টি করেছেন, যা স্বামীজি নিজজীবনে প্রতিফলিত করে সমগ্র বিশ্বকে সেই আলোক দেখিয়েছিলেন। সগুণ ও নির্গুণ উভয় ব্রহ্মের উপাসনা ও উত্তরণ—এটাই স্বামীজি প্রচারিত বেদান্তধর্মের বৈশিষ্ট্য। তিনি সমষ্টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সমাজ গঠন না হলে, জাতি গঠন না হলে ধর্মাচরণ করবে কে! বেদান্তের যে ঐক্যভাব তা আশ্রয় করলে, অপরের যন্ত্রণা অনুভব করা যায়। যে সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন ক্ষুধার্ত, ঈশ্বরকে বলতে পারে যে, ঈশ্বর তুমিও ক্ষুধার জ্বালায় কাতর হয়ে মরবে, সেই সমাজে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, মানুষের মধ্যে অধ্যাত্মচেতনার বীজ বপন করে ধীরে ধীরে পবিত্র জাতি গঠন করা, অন্যান্য ধর্মাচরণের থেকে অনেক অনেক বেশি প্রয়োজন। স্বামীজি এই কারণেই গীতার কর্মযোগের প্রচার ও ব্যাখ্যা করেছেন, কর্মের মাধ্যমেই উত্তরণ বা প্রাপ্তি।

যুবসমাজ ও স্বামীজি

       আত্মিক উন্নতির জন্য স্বামীজি যে ধরণের অভ্যাসের কথা বলেছেন, তা একটি স্বতন্ত্র যাপনের স্পষ্ট নির্দেশ দেয়। যে যাপন বা অনুশীলন প্রৌঢ় বা বৃদ্ধাবস্থায় সম্ভব নয়। স্বভাবগত প্রবৃত্তি দূর করতে হলে তা তরুণ বয়স থেকেই অভ্যাস করা দরকার। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, গাছ, চারা থাকতেই বেড়া দিতে হয়, না হলে গরু-ছাগলে মুড়িয়ে খায়। স্বামীজি বলছেন, “অসংযত ও উচ্ছৃঙ্খল মন আমাদের নিয়ত নিম্ন থেকে নিম্নতর স্তরে নিয়ে যাবে এবং চরমে আমাদের বিধ্বস্ত করবে, ধ্বংস করবে। আর সংযত ও সুনিয়ন্ত্রিত মন আমাদের রক্ষা করবে, মুক্তিদান করবে।”

“সাফল্য লাভ করিতে হইলে প্রবল অধ্যবসায়, প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি থাকা চাই। অধ্যবসায়শীল সাধক বলেন, ‘আমি গণ্ডূষে সমুদ্র পান করিব। আমার ইচ্ছামাত্র পর্বত চূর্ণ হইয়া যাইবে।’ এইরূপ তেজ, এইরূপ সংকল্প আশ্রয় করিয়া খুব দৃঢ়ভাবে সাধন কর। নিশ্চয়ই লক্ষে উপনীত হইবে।”

“হে বীরহৃদয় যুবকগণ, তোমরা বিশ্বাস কর যে, তোমরা বড় বড় কাজ করবার জন্য জন্মেছ। ওঠ, জাগো, আর ঘুমিও না; সকল অভাব, সকল দুঃখ ঘুচাবার শক্তি তোমাদের ভিতরেই আছে। এ কথা বিশ্বাস করো, তা হলেই ঐ শক্তি জেগে উঠবে।”

“সমাজসেবার আদর্শে শিক্ষার্থীকে উদ্বুদ্ধ ও নিযোজিত করা দরকার।”

তারুণ্যের উদ্যম ও শক্তির উপর গোটা দেশের ভবিষ্যত নির্ভর করে। তাই তাঁর বাণী, জীবন, রচনা তরুণ হৃদয়েই প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। তিনি প্রতিনিয়ত তাঁর বাণীতে উৎসাহ যুগিয়ে চলেছেন, আজও। আমরা দেখেছি, ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলনে, কত কত বিপ্লবী তাঁর আদর্শে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের জন্য সমর্পিত হয়েছেন, তার জ্বলন্ত উদাহরণ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। মাস্টারদা সূর্য সেন কতখানি বিবেকপ্রেমী ছিলেন, তার সাক্ষ্য পাওয়া যায় তাঁর সহকর্মী অনন্ত সিংহের লেখায়, “মাস্টারদা… বিনয়ের সঙ্গে অথচ অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে চারজন বিপ্লবী বন্ধুকে বললেন, ‘আমরা চট্টলার বুকে বসে মাত্র এই পাঁচজনে ভারতের স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবের পরিকল্পনা করছি। আমার মনে হয় বর্তমানে মূলত আনন্দমঠের আদর্শে বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের চলা উচিত এবং মা-কালী পূজা, স্বামী বিবেকানন্দের কর্মযোগের বাণী ও গীতাপাঠ কর্তব্য হওয়া প্রয়োজন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

সবাই আলোচনার পরে মাস্টারদার এই সমস্ত প্রস্তাবগুলো মেনে নিলেন। প্রত্যেকের নিজের ঘরে মা-কালীর ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, স্বামী বিবেকানন্দের ছবি, ও একখানা গীতা রাখাটা নিয়মে পরিণত হল। আমাদের পরে যারা দলভুক্ত হয়েছে তারাও মা-কালী ও স্বামীজীর ছবি ঘরে রাখত এবং গীতা সঙ্গে রাখত।”

ঋষি অরবিন্দকেও স্মরণ করতে হবে। তাঁর আধ্যাত্মিক উন্মেষ ও আধ্যাত্মিক চেতনার দ্বারা সমাজ গঠনের যৈ প্রচেষ্টা, তা স্বামীজির দ্বারাই অনুপ্রাণিত।

স্বামীজি এক নতুন ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে প্রথমে সমাজতান্ত্রিক উপায়ে প্রথমে দারিদ্র্যের মোচন, পরে চেতনার উন্মেষ ঘটানো। এই কাজে প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ যুবশক্তি। ১৯৮৫ সাল থেকে ভারতে জাতীয় যুব দিবস পালিত হচ্ছে। একটাই উদ্দেশ্য, তাঁর জীবন থেকে দেশের যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করা।  

পরিশিষ্ট

       “ভারতকে জানতে চাইলে বিবেকানন্দের লেখা পড়ো। তার মধ্যে সব কিছুই ইতিবাচক। নেতিবাচক কিছুই নেই।” বিবেকানন্দ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন এ কথা। এই মহাজীবনকে জানতে হলে তাঁর লেখা ছাড়া গতি নেই। এই সামান্য প্রবন্ধে তাঁকে বোঝা আর মহাসাগরে কাগজের নৌকা ভাসানো একই ব্যাপার। প্রস্তাবনাতেই যে গুরুতত্ত্বের আলাপ করা হয়েছে, তা এই মাত্র বোঝঝানোর জন্য—আগমাদি শাস্ত্রের প্রবক্তা শিব যেমন গুরুমূর্তি, ঠিক তেমনই হিন্দু নবজাগরণের সাহিত্যে স্বামী বিবেকানন্দই সাক্ষাৎ শিবাবতার ও গুরু। আগত ১২ জানুয়ারি ২০২১ কেবল একটি তারিখমাত্র নয়। বর্তমান প্রান্তিক সময়ে নতুন যুগের আহ্বানে এই তরুণ সন্ন্যাসীই হোন ভারতের নবজাগরণের আদর্শ।

Ganesh Thakur

0 Reviews

Related post