বঙ্গীয় সারস্বতোৎসব

 বঙ্গীয় সারস্বতোৎসব

মাঘে মাসি সিতে পক্ষে পঞ্চমী যা শ্রিয়ঃ প্রিয়া।

তস্যাং পূর্বাহ্ন এবেহ কার্যঃ সারস্বতোৎসবঃ।।

প্রতি ঋতুসূচক যজ্ঞের মধ্যে বসন্তঋতুর যে যজ্ঞ, তাই-ই বর্তমানে শ্রীপঞ্চমী, বসন্ত উৎসব বা সরস্বতীপূজা নামে খ্যাত। মাঘমাসে শুক্লপক্ষে পঞ্চমী তিথিতে পূর্বাহ্নে সরস্বতী, লক্ষ্মী, মস্যাধার, লেখনী, পুস্তক, বাদ্যযন্ত্রসহ যে পূজার আয়োজন করা হয়, তাই-ই সরস্বতী পূজা। যদিও শাস্ত্রমতে ঐদিন বিদ্যারম্ভ তিথি নয়, বরং অনধ্যায়  হিসেবে পরিচিত, তবুও  বাঙালি হিন্দুগৃহে এই দিন হাতে-খড়ির প্রচলন রয়েছে, এইটিকে লোকাচার হিসাবে দেখা যায়। লোকশ্রুতি আছে, সনাতন ধর্মের আদিগুরু বিষ্ণু-অবতার শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস বদরিকাশ্রমে এই তিথিতে সিদ্ধিলাভ করেন এবং বদরিকা অর্থাৎ কুল ফল দ্বারা সরস্বতীর অর্চনা করেন। সরস্বতী নদী সত্যিই বদরিকাশ্রম সংলগ্ন স্থান দিয়ে বাহিত হয়েছেন এবং সেখানে তাঁর মন্দিরও রয়েছে।

ওঁ তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ

কুচভর-নমিতাঙ্গী সন্নিষণ্ণা সিতাব্জে।

নিজ-করকমলোদ্যল্লেখনীপুস্তকশ্রীঃ

সকলবিভবসিদ্ধ্যৈ পাতু বাগ্‌দেবতা নঃ।।

অম্বিতমে নদিতমে দেবিতমে সরস্বতি। মাতৃকাগণের মধ্যে, নদীর মধ্যে, দেবীর মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠা। ঋকবেদের সরস্বতী সূক্তে তাই বলা হয়েছে। তিনি চন্দ্রের তরুণ কিরণের আভা, তিনি স্তনযুগ্মে অমৃতধারিণী, শ্বেতপদ্মে তাঁর অবস্থান। তিনি করকমলে উদ্যত লেখনী ও পুস্তক ধারণ করেছেন। সকল বৈভবদাত্রী বাগ্‌দেবতা সরস্বতী আমাদের রক্ষা করুন। এইরূপে ধ্যান করে ষোড়শ উপাচারে দেবীর পূজা করতে হয়। তারপর ঋতুদ্ভব শস্যাদি, পলাশ-কুন্দাদি পুষ্প এবং রাগদ্রব্যসকল দেবীকে অর্পণ করতে হয়। এখান থেকেই ঋতুরাজ বসন্তের আগমনী বেজে ওঠে। তারপর কণ্ব ঋষি, নারদ ঋষি, লক্ষ্মীদেবী, নারায়ণ, মস্যাধার, লেখনী, পুস্তক, বাদ্যযন্ত্র, হংসবাহন প্রভৃতির পূজা হয়। পরদিবস দেবীর পুনঃপূজান্তে দধিকর্মা করে দেবীর নিরঞ্জন করা হয়।

      দেবী সরস্বতী বৈদিক যুগ থেকে সমাজ ও ধর্মের বিভিন্ন শাখায় প্রভাব বিস্তার করেছেন। একদিকে তিনি নদীর দেবী, সরসবতী, রস অর্থে জল, জল মানেই উর্বরতা, তাই কৃষিমণ্ডলের সঙ্গে তাঁর যোগ আছে। সরস্বতী নদীর সভ্যতা বহু প্রাচীন, সঠিক গবেষণাতেও তাঁর সঠিক সময়কাল নির্ণয় করা যাবে কিনা, সন্দেহ আছে। পলাশপ্রিয়া সরস্বতীর পলাশ ফুলের রঙ সেই উর্বরতার প্রতীক, যা মানবসমাজকে উর্বর করে রেখেছে। অন্যদিকে বৈদিক ঋষিরা তাঁকে পিতৃযজ্ঞের অংশ বলেছেন, এখনও কোথাও কোথাও শ্রীপঞ্চমীর দিন পিতৃতর্পণ হয়ে থাকে। বেদে সরস্বতী যত প্রকট, অধুনা পূজিতা কোনও দেবীই এত প্রকট নন। সাহিত্যেও তিনি রসসঞ্চার করেন, কবি জয়দেব লিখছেন,

“যদি হরি স্মরণে সরসং মনো-

যদি বিলাসকলাসু কুতূহলং।

মধুরকোমলকান্তপদাবলীং

শৃণু তদা জয়দেব সরস্বতীম্‌॥”

যদিও এখানে পদাবলীকেই সরস্বতী বলা হয়েছে। তবু কবি কি অবচেতনেও দেবী সরস্বতীকে এই শ্লোকের মাধ্যমে স্মরণ করেননি? বিদ্যার দেবী তিনি, বিদ্যা তো কেবল জ্ঞান নয়, রসের উত্তরণও বটে। আবার যোগদৃষ্টিতে তিনি বর্ণেশ্বরী। আমাদের এই সূক্ষ্মশরীরে বিন্যস্ত থাকেন তিনি, প্রতি অঙ্গে, প্রতি চক্রের দলে দলে। শ্রীশ্রীচণ্ডীর চরিত্রত্রয়ের শেষ চরিত্র মহাসরস্বতী। তিনি অষ্টভুজা, সূর্যতত্ত্বপ্রকাশিনী এবং শুম্ভাদিদৈত্যমর্দিনী। তন্ত্রে তিনি বীণাবাদিনী শুকধারিণী মাতঙ্গী। শ্রীপঞ্চমী তিথিও এই মাতঙ্গী নবরাত্রিরই অন্তর্গত।

      শ্রীপঞ্চমী তিথি আরো দুইটি কারণে বিশেষভাবে বাঙালিজাতির কাছে গৌরবময় ও উল্লেখযোগ্য। এই তিথিতেই বাংলার প্রথম মহাকাব্যকার কবি কৃত্তিবাস ওঝার জন্ম। তিনি নিজেই লিখেছেন,

“আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পুণ্য মাঘমাস।

তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস॥”

বাঙালির অত্যন্ত গর্বের এই তিথি, গ্রামরত্ন ফুলিয়াতে জন্ম নিয়েছিলেন ‘শ্রীরাম পাঁচালি’-র পদকর্তা কবি কৃত্তিবাস ওঝা। আবার এই তিথিতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর শক্তিস্বরূপা। যিনি বর্তমান গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের পরিচায়িকা। গৌরনাগরী ভাবের উপাসকগণ গৌর-বিষ্ণুপ্রিয়াযুগলেরই উপাসনা করেন। শ্রীকৃষ্ণের প্রেম যেমন শ্রীরাধা দেখিয়েছেন, সেই প্রেমই কলিকালে গৌরাঙ্গ প্রচার করেছেন। আর বিষ্ণুপ্রিয়া প্রচার করেছেন গৌরাঙ্গের প্রেম। গৌরের সন্ন্যাসগ্রহণের পর তিনি গৌরপ্রেমে যে যাপন দেখিয়েছেন তা বাংলার লোকসমাজে ও ভক্তি-আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল।

এই সকল কিছু মিলিয়েই বাংলার সারস্বত উৎসব, বসন্ত উৎসবের সূচনা। তবে এ প্রসঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রসঙ্গের খানিক অবতারণা না করলেই নয়। বিগত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থার যে দুরাবস্থা তাতে সারস্বত সাধনা কতদূর বিস্তৃত হবে তা বলা মুশকিল। কোভিড-পরবর্তী সময়ে বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়েছে। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের মতো পরীক্ষার মূল্যায়ণ যেভাবে করা হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যত আরও অন্ধকার। ডিজিটাল পড়াশোনার যুগে বেড়েছে স্কুলছুট। বাড়ছে বেকারত্ব। রাজ্যে এককেন্দ্রিক শাসনের জেরে বাকি অনেক দপ্তরের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাদপ্তরও দক্ষ তত্ত্বাবধান থেকে বঞ্চিত হয়ে শিশুসুলভ সিদ্ধান্তহীনতার ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। দেবীর কাছে প্রার্থনা করি, এই তমো-অন্ধকার দূরীভূত হয়ে চেতনার আলো, শুভ্রতা আসুক। আধ্যাত্মিক চেতনার থেকেও এই বাংলায় রাজনৈতিক চেতনারই বর্তমান প্রয়োজন বেশি।

মেধে সরস্বতী বরে ভূতি বাভ্রবি তামসি।

নিয়তে ত্বং প্রসীদেশে নারায়নী নমোঽস্তুতে।।

Ganesh Thakur

0 Reviews

Related post