বঙ্গসমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে দেশবন্ধু
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে আমরা সাধারণত একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবেই চিনি। সেটা অবশ্যই তাঁর সমস্ত পরিচয়ের মধ্যে অন্যতম মহৎ একটি পরিচয়, তা সত্ত্বেও তাঁর অন্যান্য পরিচয়গুলিও বাংলার সমাজ-সংস্কৃতিতে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। তিনি একাধারে সুবক্তা, জননেতা, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, এবং সাহিত্যিক হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের জগতেও এক বিপুল অবদান রেখে গেছেন তিনি। তাঁর এই সমস্ত পরিচয় আমাদের প্রণোদিত করেছে তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য। তাঁর পুণ্য জীবন ও কর্মধারা বর্তমান ছাত্রযুব সম্প্রদায়ের কাছে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে, দেশ ও দশের ভবিষ্যৎ বিপ্লবের সুখ বয়ে আনবে।
চিত্তরঞ্জনের অবদান শুধু তাঁর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। স্বাধীনতা আন্দোলনে যদি সহিংস আন্দোলনের প্রসঙ্গ আসে তবে অনুশীলন সমিতির নাম সর্বপ্রথম উচ্চারিত হবে। সেই অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে অরবিন্দ ঘোষের সহকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। আবার এই অরবিন্দ ঘোষ আলিপুর বোমা মামলায় যখন কারাগারে বন্দি তিনি তখন আবির্ভূত হয়েছেন ব্যারিস্টার হিসাবে। 1894 সালে কলকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার হিসাবে যোগদান করেছিলেন তিনি। ব্রিটিশদের হাত থেকে অরবিন্দ ঘোষ মুক্ত হয়েছিলেন তাঁরই দক্ষতায়। ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায়ও তাঁর অবদান ছিল। চিত্তরঞ্জন এর জন্ম কলকাতায় 5 নভেম্বর 1870 সালে। ছোট থেকেই আপনভোলা, দুষ্টমিতে ভরা সরল তিনি। প্রেসিডেন্সি থেকে পাস করে লন্ডনে যান আইসিএস পড়তে। যদিও রাজনৈতিক সক্রিয়তার কারণে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি তার আইসিএস হওয়া। তবে ব্যারিস্টারি পাস করেছিলেন তিনি। পিতৃঋণ শোধ করার জন্য, দেউলিয়া উপাধি ঘোঁচাবার জন্য তিনি অস্বাভাবিক পরিশ্রম করেছেন। আদালতে খেটেছেন, কলেজে পড়িয়েছেন, হেঁটে যাতায়াত করেছেন। তাঁর এই জীবন কর্মযোগের শিক্ষা দিয়েছে আমাদের। আবার পিতৃঋণ থেকে মুক্ত হবার পর তাঁর যে বিপুল উপার্জন এবং তার প্রতি অনাসক্তি, আমাদের সেই কর্মযোগের ভাবকেই দৃঢ় করে। তাঁর দেশবন্ধু হয়ে ওঠার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে যখনই কোন সাহায্য প্রার্থী তাঁর কাছে হাত পেতে ছিল তিনি তাকে ফেরাননি। তাঁর অর্জিত যাবতীয় সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন দেশের মানুষের জন্য বিশেষত স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য। দেশের প্রতি, বাংলার প্রতি তার গভীর জাতীয়তাবোধ, প্রেম ছিল। তিনি আইনজীবীর পেশা ছেড়ে দিয়েছিলেন একসময়। তখন সমস্ত ঐশ্বর্য ছেড়ে খাদি কাপড়, ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীর কামরা, সাধারণ জীবনকে আপন করে নিয়েছিলেন সাদরে।
শিল্প সাহিত্যের প্রতি তাঁর অবিচল ভালোবাসা ছিল। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জাতীয়তাবাদ নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও দুজনের মধ্যে সাহিত্য-সংগীতের আদান-প্রদান হত। আবার রবীন্দ্রনাথের কোন লেখা তাঁর খারাপ লাগলেও তিনি তা সরাসরি জানাতে দ্বিধাবোধ করতেন না। নির্ভীক ও স্পষ্টবাদী ছিলেন তিনি, তার প্রমাণ পাওয়া যায় চৌরিচৌরার ঘটনায় আন্দোলন প্রত্যাহারের নিন্দার সময়। অথচ গান্ধীজির সঙ্গে আমরা দেখেছি তাঁকে চরকায় সুতো কাটতে। সত্যাগ্রহ নিয়ে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন। এখান থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়, ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা সামাজিক সম্পর্ক কখনোই রাজনৈতিক বা আদর্শগত ভেদের কারণে নষ্ট হতে পারে না। আমরা প্রতি মুহূর্তে যে রাজনৈতিক বা আদর্শগত মতপার্থক্য নিয়ে ব্যক্তিগত বিরোধ সৃষ্টি করি, মহাজন গত পন্থা নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, “আপন দানের দ্বারাই মানুষ আপন আত্মাকে যথার্থভাবে প্রকাশ করে। চিত্তরঞ্জন তাঁহার যে সর্বশ্রেষ্ঠ দান দেশকে উৎসর্গ করিয়াছেন, তাহা কোন রাষ্ট্রিক বা সামাজিক কর্তব্যপালনের আদর্শ মাত্র নহে; তাহা সেই সৃষ্টিশক্তিশালী মহাতপস্যা, যাহা তাহার ত্যাগসাধনের মধ্যে অমৃতরূপ ধারণ করিয়াছে।” রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্য থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে তার এই নিরাসক্ত জীবনকে রবীন্দ্রনাথ কতটা শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তাঁকে দানবীর বলা হয়, কিন্তু সেই বীরত্বের পেছনে তাঁর যে কর্মযোগ, সেটিকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না। বিপুল ঋণের বোঝা নিয়ে তিনি আদালতে আদালতে ছুটে বেড়িয়েছেন অর্থের আশায়। কিন্তু কখনো ভুলে যাননি, যে অসহায় মানুষটি দারিদ্র্যের কারণে সুবিচার পাচ্ছেন না তার জন্যও লড়তে হবে। এই কারণেই তিনি দেশবন্ধু। সুদিনে, দুর্দিনে উভয়তই তিনি পাশে ছিলেন দেশের মানুষের। এই যে সামাজিক বোধ তা আমাদের ভাবায়। আমাদের চিন্তা করতে শেখায়, আমরা সমাজের জন্য কতটুকু দিতে পেরেছি!
তাঁর জীবন নিয়ে আলোচনায় আরেকটি বিষয় অনালোচিত থাকে, তা হল তাঁর বিপুল সাহিত্যকীর্তি। কবি-লেখক হিসাবে তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি, অনাবিষ্কৃতই থেকে যায়। ভারতীয় দর্শন তাঁর লেখার মধ্যে বিমুর্ত হয়ে রয়েছে। দেশ সংক্রান্ত, বিশেষত বাংলা সংক্রান্ত যে লেখাগুলি উনি লিখেছেন, তাতে থরে থরে সজ্জিত আছে প্রেম, আবেগ ও ভক্তি। দেশবন্ধু, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে নিয়ে অত্যন্ত গৌরবান্বিত ছিলেন। বাংলার, বাঙালির যা কিছু নিয়ে গর্ব করা যায়, যাঁদের নিয়ে গর্ব করা যায় তারমধ্যে মহাপ্রভু অবশ্যই একজন। তাঁর লেখাগুলি পড়লে আমরা দেখতে পাবো, ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা তিনি কিভাবে মরমে গেঁথে রেখেছিলেন। একইভাবে, বাংলার কৃষি, বাণিজ্য, গৃহধর্ম, নিয়েও সম ব্যুৎপত্তি সহকারে তিনি বক্তব্য রেখেছেন। ‘বাঙ্গলার গীতিকবিতা’ শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখ পদকর্তাদের পদ ধরে ধরে বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন বাংলার সভ্যতা, সংস্কৃতির সঙ্গে কিভাবে এগুলি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে। বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি রামপ্রসাদ সেনের শাক্ত পদ গুলি আলোচনা করে তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, কালী কিভাবে বাংলার স্বদেশী আন্দোলনের জননী হয়ে উঠেছেন। শ্রীচৈতন্যকে তিনি কেবল ভক্তি আন্দোলনের নায়ক হিসাবে দেখাননি, বরঞ্চ, করে তুলেছেন রাষ্ট্রনায়ক। এই ভাবধারা আমাদের অনুপ্রাণিত করবে যে ইতিহাস কেবল অধ্যয়নের বিষয় নয় বরঞ্চ অনুসন্ধানের বিষয়, অনুধ্যানের বিষয়। শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারাকেও তিনি একই দৃষ্টিতে দেখেছেন। বৈষ্ণব রসশাস্ত্র এবং শাক্ত ভাবধারা উভয়ই বাংলায় এক অনন্য মাত্রায় ছেয়ে আছে এবং তা কতটা মৌলিক তা সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। রামপ্রসাদী সংগীত এবং ব্রহ্মসঙ্গীতের যে ঐক্য তা দেখিয়েছেন তিনি। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের এক অনন্য বিশ্লেষণ করেছেন তিনি, যেখানে বলেছেন, আনন্দমঠ, সীতারাম, দেবী চৌধুরানী প্রমূখ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালিকে বাঙালি হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছেন। জাতি বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির ঐতিহ্য, পারম্পর্য রক্ষার জন্য চিত্তরঞ্জন বারংবার আমাদের জাগ্রত হতে বলেছেন। তাঁর রচনার মধ্যে সেই আবেগমথিত ডাক লুকিয়ে রয়েছে। একজন সম্পূর্ণ বাঙালি অথবা বাংলাবাদীর যদি সংজ্ঞা প্রয়োজন হয়, তবে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশই সেই মূর্তিমান সংজ্ঞা।
১৬ জুন, ১৯২৫, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মহাপ্রয়াণে ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ।
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।।
কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন,
হায় চির-ভোলা! হিমালয় হতে
অমৃত আনিতে গিয়া
ফিরিয়া এলে যে নীলকণ্ঠের
মৃত্যু-গরল পিয়া!
কেন এত ভালো বেসেছিলে তুমি
এই ধরণির ধূলি?
দেবতারা তাই দামামা বাজায়ে
স্বর্গে লইল তুলি!