ফল্গু-উৎসব

 ফল্গু-উৎসব

বাংলায় দুর্গাপূজা ব্যাপকভাবে প্রসারিত হওয়ার আগে যে স্মার্ত উৎসবগুলি সর্বাধিক লোকপ্রিয় ছিল তা হল, দোলযাত্রা, রথযাত্রা প্রভৃতি উৎসব। বিভিন্ন স্মৃতিগ্রন্থে, পুরাণে দোলযাত্রার পূর্ণাঙ্গ বিধি দৃষ্ট হয়। শ্রীকৃষ্ণের দ্বাদশযাত্রার মধ্যে অন্যতম হল দোলযাত্রা।

বিশেষতঃ কলিযুগে দোলোৎসবো বিধীয়তে।

ফাল্গুনে চ চতুর্দশ্যামষ্টমে যামসংজ্ঞকে।।

অথবা পৌর্ণমাস্যান্তু প্রতিপতসন্ধিসম্মিতৌ।

পূজয়েদ্বিধিবদ্ভক্ত্যা ফল্গুচূর্ণৈশ্চতুর্বিধৈঃ।।

সিতরক্তের্গৌরপীতৈঃ কর্পূরাদিবিমিশ্রিতৈঃ।

হরিদ্রাক্ষারযোগাচ্চ রঙ্গরম্যৈর্মনোহরৈঃ।।

অন্যৈর্বা রঙ্গরম্যৈশ্চ প্রীণয়েত পরমেশ্বরম্।

—পদ্মপুরাণে পাতালখণ্ডে।

ফাল্গুন মাসে পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা সম্পন্ন হয়। দোলনায় ভগবানকে দোল দেওয়া এবং ফল্গুসহ ভগবানে প্রীতি উৎপন্ন করাই এই উৎসবের কৃত্য। দোলযাত্রার পূর্বদিনে বহ্ন্যুৎসব বা চাঁচর বা মেড়াপোড়া বা বুড়ির ঘর পোড়ানোর আচার দেখা যায়। শীতের যত শুকনো ডালপালা, খড়-বিচালি সব দিয়ে একটি ঘর বা পুতুল বানিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। একে অনেক জায়গায় হোলিকাদহনও বলা হয়। এর প্রেক্ষিতে ভক্ত প্রহ্লাদের একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। হিরণ্যকশিপু হোলিকা নামের এক অসুরকে প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে চিতায় বসিয়ে অগ্নিসংযোগ করেন। ব্রহ্মার বরে একটি বিশেষ বস্ত্রের জন্য হোলিকা অদাহ্য ছিল। কিন্তু বিষ্ণুর আশীর্বাদে হোলিকা ভস্মীভূত হয়ে যায়, প্রহ্লাদ রক্ষা পায়। সেই থেকেই অঞ্চলবিশেষে এই আগুনের উৎসবকে হোলিকাদহন বলা হয়। আবার চন্দ্রের মঘা নক্ষত্র থেকে মাঘ মাসের নাম, যেমন ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন। মঘা নক্ষত্র থেকে পূর্ণচন্দ্র ফাল্গুনী নক্ষত্রে গমন করলে চান্দ্র ফাল্গুন মাস শুরু হয়। আর জ্যোতিষে কথিত আছে, মঘা নক্ষত্র সপ্তবিংশতি নক্ষত্রের মধ্যে উজ্জ্বলতম এবং পিতৃগণের দ্যোতক বলে ধরা হয়। উজ্জ্বলতম মঘা থেকে চন্দ্রের এই সংক্রমণের উপলক্ষ্যেই কি এই বহ্নি-উৎসবের আয়োজন? নাকি এটি পিতৃপুরুষদের বাসন্তী আলো দেখানোর উৎসব, কারণ এই অগ্নিকে স্মৃতির একস্থানে দক্ষিণাগ্নি নামে অভিহিত করা হয়েছে। মঘার আকৃতির সঙ্গে মেষের আকৃতির সাযুজ্য আছে। সেজন্য স্মৃতিশাস্ত্রে বহ্ন্যুৎসবের স্তূপে বা ঘরে একটি ক্ষীরময় বা জীবন্ত মেষ রাখার বিধি দৃষ্ট হয়, এই গৃহকে মেষমন্দিরও বলা হয়েছে, মেষ থেকে মেড়াপোড়া শব্দটি এসেছে। কেবল লোকাচার নয় এটি, কারণ স্মৃতিগ্রন্থে এর প্রমাণ আছে।

ফাল্গুন্যাঃ পূর্বতো বিপ্রাশ্চতুর্দশ্যাং নিশামুখে।

বহ্ন্যুৎসবং প্রকুর্বীত দোলমণ্ডপপূর্বতঃ।। —জৈমিনি।

      প্রথমদিন চাঁদোয়া ও পতাকা-চামরশোভিত চতুর্দ্বার ও ষোড়শস্তম্ভমণ্ডিত মণ্ডপে অধিবাস ও তার সামনে চাঁচর শেষ হলে পরেরদিন যুগলকে দোলমণ্ডপে যথাবিধি পূজার পর ফল্গু বা ফাগ বা আবির ও নানাধরণের সুগন্ধি দিয়ে ক্রীড়া রচিত হয়, এবং দোলিকায় দোল দেওয়া হয়। তারপর শীতল পানীয়, সরবত, মিষ্টান্ন প্রভৃতী নিবেদন করা হয়। মধ্যাহ্নে নানাবিধ সুগন্ধি ও জল দ্বারা বিগ্রহের অভিষেক সম্পন্ন হলে পুনঃপূজা হয় এবং বিগ্রহ 

      বাংলার স্মৃতিশাস্ত্রে পূর্ণিমা থেকে পঞ্চমী অবধি দোলের বিধান রয়েছে। এখন এই বিধি নবরাগে সুসজ্জিতা হন। এই হল দেবদোলবিধি।প্রচলিত না থাকলেও কিছু বৈষ্ণব ঘরানায় এখনও অনাড়ম্বরভাবে পালিত হয়। শ্রীধাম বৃন্দাবনে সপ্তাহব্যাপী হোলি উৎসব পালিত হয়। অবাঙালি গোষ্ঠীতে  শ্রীক্ষেত্র পুরীতে প্রভু জগন্নাথসহ চতুর্ধাবিগ্রহের সোনাবেশ বা রাজবেশ হয় এই দিন। এই দিনটিকে বসন্ত রাস নামেও অভিহিত করা হয়। শ্রীহরিভক্তিবিলাস গ্রন্থে রাকাপূর্ণিমানুরোধে এই দিন নৃত্যগীতাদিসহ রাত্রিজাগরণের বিধান রয়েছে। জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যে বসন্তকাল এবং রাসের বর্ণনা রয়েছে।

ললিতলবঙ্গলতাপরিশীলনকোমলমলয়সমীরে। মধুকরনিকরকরম্বিতকোকিলকূজিতকুঞ্জকুটীরে।।বিহরতি হরিবিহ সরসবসন্তে। নৃত্যতি যুবতিজনেন সমং সখি বিরহিজনস্য দুরন্তে।।ধ্রু।। উন্মদমদনমনোরথপথিকবধূজনজনিতবিলাপে। অলিকুলসঙ্কুলকুসুমসমূহনিরাকুলবকুলকলাপে।। মৃগমদসৌরভরভসবশংবদনবদলমালতমালে। যুবজনহৃদয়বিদারণমনসিজনখরুচিকিংশুকজালে।। মদনমহীপতিকনকদণ্ডরুচিকেশরকুসুমবিকাশে। মিলিতশিলীমুখপাটলিপটলকৃতস্মরতূণবিলাসে।। বিগলিতলজ্জিতজগদবলোকনতরুণকরুণকৃতহাসে। বিরহিনিকৃন্তনকুন্তমুখাকৃতিকেতকিদন্তুরিতাশে।। মাধবিকাপরিমলললিতে নবমালিকয়াতিসুগন্ধৌ। মুনিমনসামপি মোহনকারিণী তরুণাকারণবন্ধৌ।। স্ফুরদতিমুক্তলতাপরিরম্ভণপুলকিতমুকুলিতচূতে। বৃন্দাবনবিপিনে পরিসরপরিগতযমুনাজলপূতে।। শ্রীজয়দেবভণিতমিদমুদয়তি হরিচরণস্মৃতিসারম্। সরসবসন্তসময়বনবর্ণনমনুগতমদনবিকারম্।।

আবার,

করতাল-তাল-তরলবলয়া-বলিত-কলিত-কলস্বনবংশে। ‘রাসরসে’ সহনৃত্যপরা হরিণা যুবতিঃ প্রশংসে।।

প্রত্যেক পূর্ণচন্দ্রের তিথিই আসলে যুগলকিশোরের রাসরসে মিলনতিথি। তবু কিছু ঋতুর পূর্ণিমা বিশেষভাবে মহারাস নামে কথিত। ফাল্গুন পূর্ণিমা তেমনই এক তিথি, মহারাসের তিথি।

      এক সময় বাংলায় গৃহে গৃহে, মন্দিরে মন্দিরে, দোলযাত্রা সাড়ম্বরে পালিত হত। রাধাশ্যামের যুগলবিগ্রহে, বালগোপাল বিগ্রহে, এমনকি শালগ্রাম শিলাতেও দোল অনুষ্ঠিত হত। ‘নেড়াপোড়া’ ছিল শৈশবের এক উজ্জ্বল আনন্দের দিন। সেই শৈশব আজ লুপ্তপ্রায়। গৃহে গৃহে সেই আড়ম্বরও কম। কিছু বৈষ্ণব মঠ-মন্দিরে তবু জাঁক আছে এখনও। ভোজনরসিক বাঙালির সিংহভাগের জাঁক এখন মাংস এবং মদ্যে এসে ঠেকেছে। একটু টলমল পায়ে রঙ না খেললে দোলের মজা ঠিক আসে না। একদিকে কুক্কুটাসবপ্রিয় বাঙালি, অন্যদিকে রাবীন্দ্রিক বসন্তোৎসবপ্রিয় বাঙালি, মাঝে ব্রাত্য হয়ে থাকে শ্যামরাইয়ের ফাগ আর চৈতন্যের বাংলা।

Ganesh Thakur

0 Reviews

Related post