নবান্ন উৎসব

 নবান্ন উৎসব

“এসেছ বন্ধু? তোমার কথাই জাগছিল ভাই প্রাণে,-

কাল রাতে মোর মই প’ড়ে গেছে ক্ষেতভরা পাকা ধানে।

ধান্যের ঘ্রাণে ভরা অঘ্রানে শুভ নবান্ন আজ,

পাড়ায় পাড়ায় উঠে উৎসব, বন্ধ মাঠের কাজ।

লেপিয়া আঙিনা দ্যায় আল্পনা ভরা মরাইএর পাশে;

লক্ষ্মী বোধ হয় বাণিজ্য ত্যাজি’ এবার নিবসে চাষে।

এমন বছরে রাতারাতি মোর পাকা ধানে পড়ে মই!

দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস্ দিয়ে বসো,- সে দুখের কথা কই;

বোশেখ, জ্যষ্টি, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্দর, আশ্বিন,-

আশা-আতঙ্কে খেয়াল ছিল না কোথা দিয়ে কাটে দিন।

দুর্যোগে সবে বালির বাঁধনে বাঁধিনু বন্যাধারা,

বুকের রক্ত জল কোরে কভু সেচিনু পাণ্ডু চারা।

কার্তিকে দেখি চারিদিকে,- একি! এবার ত নহে ফাঁকি!

পাঁচরঙা ধানে ছক্-কাটা মাঠ জুড়ায় চাষার আঁখি।

অঘ্রানে থাকে থাকে

কাটিয়া তোলায় খামারে গোলায় যাহার যেমন পাকে।

আমি রোজ ভাবি- ফসলটা নাবি, আরও ক’টা দিন যাক্,

ভরা অঘ্রানে ঘটেনা- ত কোনো দৈব দুর্বিপাক।

মরাই-সারাই শেষ কোরে, সবে খামারে দিইছি হাত,

কাল্কে হঠাৎ,

-বন্ধু, দোহাই, তুলোনাকো হাই, হইনু অপ্রগলভ,-

ক্ষমা করো সখা, বন্ধ করিনু তুচ্ছ ধানের গল্প।”

যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘নবান্ন’ কবিতা আমরা পড়েছি ছোটোবেলায়। এই যে কোমল একখানি বিষাদ তা উৎসবের ঐশ্বর্যে রসাভাস ঘটায় না, বরং উৎসবকে আরও অনুভবময় করে তোলে। রবি ঠাকুরের বিখ্যাত গান, যা বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, তাতে বলা হয়েছে, “ওমা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কি দেখেছি মধুর হাসি, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।” এই যে সোনার উপমা, এই উপমাই তৈরি হয়েছে পাকা ধানের রঙ থেকে। অঘ্রাণে ক্ষেত ভরা ধানের যে সোনালি হাসি, তা-ই যেন বাংলার হাসি। বাংলা তো চিরকালই কৃষিপ্রধান ভূমি, এবং ভাত বাংলার প্রধান খাদ্য, তাই ধান্যভূমির সেই হাসি ক্রমে সঞ্চারিত হয় কৃষকের মুখে, তারপর আপামর বাঙালির হেঁশেলের ভাতের হাড়ি থেকে বাঙালির মুখে। অঘ্রাণে এই হাসিমাখা মুখেই পালিত হয় নবান্ন উৎসব। বর্ষায় বোনা আমন বীজের থেকে হেমন্তের শেষ পর্যন্ত এক দীর্ঘ যাত্রায় এই হাসি ফুটে ওঠে বাংলার মুখে। অঘ্রাণে নতুন ধানে তাই বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হয় নবান্ন উৎসব। কেউ-কেউ বলেন, বৈদিক যুগের থেকে চলে আসছে এই উৎসব, পুরাণে অগ্রহায়ণের শুক্লপক্ষে নব অন্নে হরি অর্চনের উল্লেখ আছে। আমরা আপাতত দৃকনিপাত করব উৎসবের লৌকিকতায়, আচারে।

আশ্বিন গেল, কার্তিক মাসে পাকিল খেতের ধান,

সারা মাঠ ভরি গাহিতেছে কে যেন হল্‌দি-কোটার গান।

ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়,

কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায়।

আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে,

মাঝে মাঠখানি চাদর বিছায়ে হলুদ বরণ ধানে।

বাংলার কোলের সন্তান জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ কাব্যে অঘ্রাণের এমনই ছবি তুলে ধরেছেন। যদিও এখানে হলুদ বরণ ধানে ‘হলদি কোটার গান’ কথাটি রূপক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে, তবে ধান কাটার গান কিন্তু লোকজ সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল বা আছে। সংগীতবিহীন কোনও উৎসবই বাংলায় হয় না। নবান্নেও তাই। মাঠে-ঘাটে লক্ষাধিক এই গোত্রের গান অসংরক্ষিত হয়ে পড়ে থাকে। বিখ্যাত গীতিকার শ্রদ্ধেয় সলিল চৌধুরীর রচিত একটি বিখ্যাত গান, ধান কাটার গান, যে গানের কণ্ঠশিল্পী ছিলেন শ্রদ্ধেয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সলিল চৌধুরীর আরও একটি ধানের গান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—

হেই সামালো হেই সামালো

হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো

জান কবুল আর মান কবুল

আর দেব না আর দেব না

রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো।

চিনি তোমায় চিনি গো জানি তোমায় জানি গো

সাদা হাতির কালা মাহুত তুমিই না

পঞ্চাশে লাখ প্রাণ দিছি, মা বোনেদের মান দিছি

কালো বাজার আলো কর তুমি না।

মোরা তুলব না ধান পরের গোলায়

মরব না আর ক্ষুধার জ্বালায় মরব না

তার জমি যে লাঙল চালায়

ঢের সয়েছি আর তো মোরা সইব না

এই লাঙল ধরা কড়া হাতের শপথ ভুলো না।

তৈত্তিরীয়োপনিষদের ব্রহ্মানন্দবল্লীতে জীবদেহের পঞ্চকোশের উল্লেখ আছে। তার মধ্যে প্রধান অন্নময় কোষ। আমাদের এই স্থূল শরীরকেই বলা হয়েছে অন্নকোষ। বৃহদারণ্যকে বলা হচ্ছে, “অন্নে হীমানি সর্বাণি ভূতাণি বিষ্টানি”। সমস্ত চরাচর জগত এই অন্নেই প্রতিষ্ঠিত। অন্ন এবং প্রাণই ব্রহ্ম, পরম। আর ধান শুধু কৃষকের নয়, আপামর বাঙালির কাছে পূজিতা লক্ষ্মীর প্রতীক রূপে। কার্তিকের সংক্রান্তির দিন মাঠের ঈশান কোণ থেকে নতুন ধান মুঠো করে আনা হয় কৃষকের গৃহে, সেই থেকে নানাবিধ মাঙ্গলিক দ্রব্যের সঙ্গে তিনি লক্ষ্মীরূপে পূজিতা হন। অঘ্রাণের শুভদিনে ধান সম্পূর্ণ পেকে গেলে হয় নবান্ন উৎসব। এই দিন গৃহদেবতাকে নতুন ধানের চাল কুটে পায়েস বানিয়ে নিবেদন করা হয়। পিঠাপুলিও হয় কোথাও কোথাও। ধানের গোলা, মড়াই ঘিরে আলপনা দেওয়া হয়। তারপর সেই অন্নপ্রসাদ গ্রহণ করা হয়। যে-কোনও ঋতুদ্ভব শস্যই আগে ইষ্ট বা গৃহদেবতাকে নিবেদন করার রীতি আছে বাংলায়। আর ধান তো প্রধান শস্য আমাদের। যাইহোক, আগে নবান্নের পরেই ধান কাটার রীতি ছিল। পৌষে পৌষলক্ষ্মী ভরা ধান্যে অধিষ্ঠান করেন।

      এই সময়কালে গ্রামবাংলায় বড়ি দেওয়ার আচারও পালন করা হয়। মেদিনীপুরের গয়না বড়ি খুবই বিখ্যাত। কর্তাবড়ি আর গিন্নিবড়ি বানিয়ে তেল-সিঁদুর, ধান-দুর্বা দিয়ে মায়েরা পূজা করেন। এছাড়াও আগেকার দিনে বিভিন্ন জিনিস ‘জিইয়ে’ রাখা হত এই সময়। কচি বাধাকপি, আমলকি, মাছ এবং আরও নানান জিনিস এই সময় নুন দিয়ে জারিয়ে জল বের করে শুকিয়ে শিকেয় তুলে রাখা হত, খাওয়া যেত বারোমাস। কাঁচা হলুদও শুকিয়ে রাখা হত। এ সমস্ত অনেক প্রাচীন গ্রামীণ প্রথা। এখন তো সব দিনেই সব পাওয়া যায়, শুধু পয়সা থাকলেই হয়। চাইলে শীতে আমও খাওয়া যেতে পারে। আগে সেসব ছিল না। এই সময়টাতে আর্দ্রতা কম থাকে বলে এইসব কাজ অঘ্রাণ-পৌষেই হত।

      বাংলার মুসলমান কৃষক সমাজেও এই সময় নবান্নের জনপ্রিয়তা আছে। আদিবাসী জনজাতিতে ‘নবান’ বা নবান্নের খুব বড়ো উৎসব হয়। নাচ-গান হয়। গান গেয়ে ধান কাটার প্রতিযোগিতা চলে। গানের ছন্দে ছন্দে ধান কাটা— এমন ধারা আর কোথাও গেলে দেখা যাবে না। ঝুমুর তালে গা দোলালে ধান কাটতে ক্লান্তি আসে না। হারিয়ে গেছে সেসব গান। দানবের মতো মেশিনের আওয়াজে সেই মধুরতা নেই। আর শহুরে জনপ্রিয়তা এখন ফেসবুক রিল আর টিকটকেই সীমাবদ্ধ। লোকশিল্পীদের গানে কোমর দুলিয়ে, বিকৃত করে, টাকা কামানো যায়, সংরক্ষণ করে তো টাকা কামানো যায় না। আর লোকশিল্পীদের এক গাল মাছি, তাঁরা বোঝেন না এসব শহুরেপনা। গান হারিয়ে যায়। যাইহোক, নবান্নের উৎসবে আধুনিকতা এলেও ভরা ক্ষেতের হাসি ম্লান হয় না। তবে এ-বছর কৃষকদের নবান্ন কেমন যাবে, তা বরুণ দেবতাই জানেন! 

Ganesh Thakur

0 Reviews

Related post