‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’

 ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি, অবিভক্ত বাংলার হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামে, ফাল্গুন মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে। আজ তাঁর ১৮৭তম জন্মতিথি। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি সেই যুগাবতারকে যিনি চৈতন্য পরবর্তী সময়ে এবং বর্তমান পর্যন্ত বাংলার শেষ এবং সফল একজন যুগপুরুষ। গৌরচন্দ্রিকা পর্ব সংক্ষিপ্ত রেখেই আজ আমরা আলোচনা করব তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। যে বিষয়টি নিয়ে জনমধ্যে আলোচনা হয়েছে এবং বিতর্ক উপস্থিত হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণের ‘কামিনী-কাঞ্চন’ ত্যাগের উপদেশ, যা স্বভাবতই বিতর্কের জন্ম দেয়। তিনি কি তাহলে বর্তমান প্রেক্ষিতে অপ্রাসঙ্গিক? যে সময়ে দাঁড়িয়ে অর্থচিন্তা মানুষের প্রধান চিন্তা, অর্থ ছাড়া সবই অচল।

প্রথমেই আসা যাক্, শ্রীরামকৃষ্ণের ‘বিষয়’-বিতর্কে। শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে আমরা দেখতে পাই তিনি বারংবার ‘বিষয়’-বিমুখ হবার কথা বলছেন। ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’—এই ধরনের বাণী বা মুদ্রাস্পর্শে তাঁর অঙ্গবিকৃতি এই জাতীয় প্রসঙ্গ আমরা পেয়েছি। লোকমাতা রাণী রাসমণি যখন মন্দিরে মায়ের সামনে বসে মোকদ্দমার চিন্তা করছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ আপন খেয়ালে রাণীর গালে প্রহার করে বলছেন, ‘এখানেও বিষয় চিন্তা!’ মন্দিরের অন্যান্য কর্মকর্তারা মারমুখী হয়ে উঠলেও রাণী শ্রীরামকৃষ্ণকে আড়াল করেন, দোষ স্বীকার করেন, ক্ষমাপ্রার্থিনী হন এবং বিস্মিতা হন, মনের চিন্তা সামনের মানুষটি জানলেন কীভাবে! শ্রীরামকৃষ্ণও তাঁর কৃতকর্মের জন্য যারপরনাই লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু অন্য স্ত্রীলোকের গায়ে হাত তোলা দূরে থাক, একবার নিজ স্ত্রী সারদামণি দেবীকে ‘তুই’ সম্বোধন করে ফেলেছিলেন বলে সারারাত অনিদ্রায় কাটিয়ে পরের দিন ভোরে শ্রীশ্রীমায়ের কাছে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আদতে এটিই পরমহংস সন্ন্যাসের লক্ষণ। তিনি অর্থচিন্তাকে অস্বীকার করেননি। স্বামী বিবেকানন্দকে কালীঘরে প্রেরণ করেছিলেন, ‘মা’-এর কাছে অর্থকষ্ট দূর করার প্রার্থনা করার জন্য। স্বামীজী বহুবার গিয়েও জ্ঞান, ভক্তি, বৈরাগ্য ব্যতীত কিছু চাইতে পারেননি। তখন শ্রীরামকৃষ্ণ তখন বলেছিলেন, “তোদের মোটা ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না।” বিষয়াশয়ের সমস্যা নিয়ে কেউ এলে তিনি শ্রীশ্রীমায়ের নিকটে প্রেরণ করে দিতেন। শ্রীশ্রীমা-কে বলতেন, “এ (শ্রীরামকৃষ্ণ) চলে গেলে তুমি কামারপুকুরে গিয়ে থাকবে, শাক বুনে খাবে আর হরিনাম করবে।” শ্রীশ্রীমা বাস্তবিকপক্ষেই তা মেনেছিলেন। আজীবন তিনি সংসার নিয়ে থেকেছেন। অথচ তাঁর ত্যাগ-তপস্যাও কত ছিল। ঠিক এই জায়গাটিতেই শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনের প্রতিফলন ঘটে। তিনি বলছেন, “এক হাতে ঈশ্বরকে ধরে থাকবে, অন্য হাতে সংসার করবে।” বা “সংসারে থাকবে পাঁকাল মাছের মতো। পাঁকাল মাছ পাঁকে থাকে, কিন্তু গায়ে পাঁক লাগে না।”

জীবনে বেঁচে থাকতে গেলে অর্থের প্রয়োজন আবশ্যিক কিন্তু যেন তা-ই আমাদের মূল প্রতিপাদ্য না হয়ে ওঠে। তিনি এসেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একদম প্রথম দিকে আর অষ্টাদশ শতাব্দী ভারতের বুকে একটি অন্যতম চাঞ্চল্যকর সময়, কত ষড়যন্ত্র, কত রাজনৈতিক পালাবদল, কত অরাজকতা, কত অন্তর্যুদ্ধ, কত বহিরাক্রমণ যে ঘটে গেছে এই সময়ে! আর আমরা জানি, আজও বিশ্বের যে-কোনও প্রান্তে যে-কোনও বিচলনের আঘাত সরাসরি নেমে আসে সাধারণ মানুষের উপর। দুর্ভিক্ষ, ফসলহানি, রাজস্বের চাপ, শোষণ এসব ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ অধ্যায় জুড়ে। মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগের এক যুগসন্ধিতে দাঁড়িয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ যে দর্শন রেখে গেছেন তা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। শ্রীশ্রীমা আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি মেয়েদের স্বাবলম্বী করার দিকেও যথেষ্ট উদ্যোগী ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের পারিবারিক ইতিহাস দেখলেও ধনী জমিদারের বঞ্চনা, কৃষিজমি, ভিটেসহ সর্বস্বান্ত হওয়া, টোল এবং যজমানি দ্বারা সংসার-নির্বাহ ইত্যাদির প্রেক্ষাপট পাব। সুতরাং তিনি যা বলেছেন, শুধুই যে সাধনোপলব্ধি থেকে বলছেন, তা নয়, এর পশ্চাতেও এক গভীর জীবনোপলব্ধি কাজ করছে।

আজ এই বস্তুবাদের রাজ্যে দিকে দিকে শুধু প্রদর্শনের মেলা। কার কত বিত্ত আছে, কার কত ঐশ্বর্য আছে সেসবের প্রতিযোগিতায় আমরা ক্রমশ এক স্তরের জড়বাদী পশুতে পরিণত হচ্ছি। আমাদের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে হলেও আমরা সামাজিক প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজে নিতে চাইছি। আমাদের চেতনা ক্রমশ যেন চিতাস্পর্শী হয়ে উঠছে। উত্তরাধুনিক যুগে সামাজিক অবক্ষয় এবং মূল্যবোধের ক্রমনমনও কম নয়।

এই প্রেক্ষিতে আমরা যদি শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনের সিকিভাগও গ্রহণ করতে পারি, তবে আমাদের জটিলতা কিছুটা হলেও কমে। অল্পে পরিতৃপ্ত হতে শিখি। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে বসার কথা। ঈশ্বরের ভাবনা বাদ দিয়েও এই জড়অরণ্য থেকে দূরে গিয়ে আমরা যদি একটু নির্জনে গিয়ে বসি, শুনতে পাব চেতনার কোলাহল, আত্মানন্দের অনুভূতি, যে অনুভূতি কোটি ‘কামিনী’, কোটি ‘কাঞ্চন’-এও আসে না, যা শুধু নির্জনতায় মেলে, সহজতায় মেলে।

Ganesh Thakur

0 Reviews

Related post