বঙ্গের নয়নাভিরাম: ইহদেশে প্রবহমানা চিরন্তনী রাম-সংস্কৃতি
রামায় রামচন্দ্রায় রামভদ্রায় বেধসে।
রঘুনাথায় নাথায় সীতায়াঃ পতয়ে নমঃ।।
বিদ্বৎমহলে গুঞ্জরণ উঠেছে, রঘুপতি কৌশল্যানন্দন শ্রীরাম বঙ্গীয় সংস্কৃতির অঙ্গীভূত নন। ইতিহাস বাঙ্ময় হলে এই দুষ্প্রচারণার জবাব স্বতই কালের গর্ভ থেকে উৎসারিত হত। দুর্ভাগ্য, বঙ্গের জলবায়ু এমনই, ইতিহাসের প্রস্তরগাত্রে উৎকীর্ণ কালের পদচিহ্ন খুব সহজেই মুছে যায়। সেই অস্পষ্ট ইতিহাসকে কিঞ্চিৎ স্পষ্ট করে দেওয়াই আমাদের কর্তব্য।
কৃত্তিবাস ও ‘শ্রীরামপাঁচালি’
আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পূর্ণ মাঘ মাস।
তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস।।
১৪৪০ খ্রিস্টাব্দ, ফুলিয়ায় জন্ম নিলেন কবি কৃত্তিবাস। বাংলার মহাকাব্যের যুগোত্থান হল। মহাকবি বাল্মিকী রচিত রামায়ণ মহাকাব্যের বাংলা অনুবাদ করলেন তিনি। কিন্তু ‘শ্রীরামপাঁচালি’ নেহাৎই একটি অনুবাদ কাব্য নয়, তার সঙ্গে জুড়ে গেল বাংলার নানান আখ্যান, লোকপুরাণ, লোকসাহিত্য। বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেল কৃত্তিবাসী রামায়ণ। বাংলার নাট্য, গীতি, কাব্যে কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রভাব বিস্তৃত হল। বাংলার গৃহে গৃহে রামায়ণ পাঠের পরম্পরা আরম্ভ হল। চণ্ডীমণ্ডপে, বারোয়ারিতলায়, ঘরের শান্ত প্রদীপের নীচে সুর করে দুলে দুলে রামায়ণ পাঠ, এই দৃশ্য কোনও বাঙালি কখনও অস্বীকার করতে পারবে না। কৃত্তিবাসী রামায়ণ লোকমুখে, পালায়, গানে, পুঁথিতে এমনিই প্রচারিত হয়ে গেছিল বঙ্গে। ‘শ্রীরামপাঁচালি’-র পুঁথি পশ্চিমবঙ্গের বহুলাংশ তো বটেই, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, সিলেট থেকেও উদ্ধার হয়েছে। মল্লভূমে প্রাপ্ত সকল পুঁথির মধ্যে রামায়ণের পুঁথিই বেশি। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হ্যালহেডের ব্যাকরণে আংশিক মুদ্রিত হয় কৃত্তিবাসী রামায়ণ। ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ উইলিয়াম কেরির উদ্যোগে শ্রীরামপুর মিশন থেকে পাঁচটি খণ্ডে প্রথম ছাপা হয় সম্পূর্ণ সপ্তকাণ্ড কৃত্তিবাসী রামায়ণ। ছেপেছিলেন মিশনারিরা। যদিও তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তাঁরা চেয়েছিলেন, শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুরা এসব পড়ে হিন্দুধর্ম ছেড়ে খ্রিস্টের আশ্রয় নেবে। কিন্তু তাঁরা নিজেরাও ভাবেননি, আগুনের মতো এই বই ছড়িয়ে পড়বে বাংলার নগর-পল্লি সর্বত্র। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপা হয়, তার বাংলা নামপত্রে লেখা আছে, ‘কৃত্তিবাস কর্তৃক গৌড়ীয় ভাষায় রচিত’। এই শ্রীরামপুর মহকুমারই একটি অখ্যাত গ্রামে জন্ম বিখ্যাত সাহিত্যিক শেখ ওয়াজেদ আলি-র। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘মাশুকের দরবার’ নামক গ্রন্থে ‘ভারতবর্ষ’ নামক একটি আশ্চর্য গল্প পাওয়া যায়। আলিসাহেব প্রথম কলকাতায় এসে একটি মুদি দোকানে দেখেন, রামায়ণ পাঠ হচ্ছে। একজন বয়স্ক মানুষ পাঠ করছেন, আর তাঁর নাতি-নাতনিরা শুনছে। পঁচিশ বছর পর আবার তিনি যখন যাচ্ছেন ঐ পথ দিয়ে, দেখলেন বয়স্ক মুদি-দোকানি আর নেই, সেই জায়গায় তাঁর ছেলে রামায়ণ পাঠ করছে। ঋষি-পরম্পরার দেশ ভারতবর্ষ।
কবি অভিনন্দ, নবম শতকের সংস্কৃত পণ্ডিত ও কবি। দেবপাল বা হরবর্ষের সভাকবি ছিলেন। চল্লিশ সর্গের ‘রামচরিত’ গৌড়ভূমিতেই রচিত হয়েছিল। তার একমাত্র উল্লেখ আছে, শতানন্দের উদয়সুন্দরী-তে। কালের গ্রাসে সে গ্রন্থের আর কোনও খোঁজ নেই। পালযুগেই রচিত হয় আরেকটি রামচরিত, সন্ধ্যাকর নন্দীর। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পাল-সেন যুগে রামায়ণের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। গোস্বামী তুলসীদাস, ভারতীয় রামায়ণী পরম্পরায় একটি জনপ্রিয় নাম। তিনি একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ও দার্শনিক হওয়া সত্ত্বেও কেন ‘আওয়ধি’-র মতো ভাষায় ‘রামচরিতমানস’ রচনা করলেন? কারণ, তিনি বুঝেছিলেন, শ্রীরামচন্দ্রের মহিমাগাথা জনমানসে অঙ্কিত করতে গেলে, এমন এক ভাষাকে আশ্রয় করতে হবে, যাতে তা ভূমিস্তরের সমাজে প্রসারিত হতে পারে। সংস্কৃত একপ্রকার ব্রাহ্মণ-বর্ণাধিকৃত ভাষা, সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এই কারণেই বঙ্গেও রামকথার প্রসার হতে সময় লেগেছিল। তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’ একইভাবে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও কৃত্তিবাসী রামায়ণ রচনার প্রায় এক শতাব্দী পরে, ১৫৭৪-এ।
বঙ্গে রামায়েত পরম্পরার চিহ্ন
বঙ্গীয় সাহিত্যভাবনার প্রারম্ভিক পর্যায় বীরভূমের কেন্দুবিল্ব গ্রামে সূচিত হয়েছিল। কবি জয়দেব জন্ম নেন দ্বাদশ শতাব্দীতে। তাঁর রচিত ‘গীতগোবিন্দ’ থেকেই বাংলা বৈষ্ণব পদাবলীর শাখা পল্লবিত হয়। ‘পদাবলী’ শব্দটাই তাঁর কাব্য থেকে এসেছে। যতদূর জানা যায়, জয়দেব রামায়েতি পরম্পরার বৈষ্ণব ছিলেন। কিন্তু তিনি রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা রচনা করলেন। হয়তো, রাম-কৃষ্ণে ভেদভাবনার সংস্কৃতি তখনও চালু হয়নি। বৈষ্ণব জগতে রাম ও কৃষ্ণ দুজনকেই পুরুষোত্তম নামে অভিহিত করা হচ্ছে গোড়া থেকেই। বঙ্গের বহু স্থানে রামায়েত সন্ন্যাসীদের চিহ্ন পাওয়া যায়। মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে হিলোড়া গ্রামের শ্যামসুন্দর বিগ্রহ আদতে রামায়েত সন্ন্যাসীদের পূজিত বিগ্রহ বলে জানা যায়। ব্যান্ডেল স্টেশনের নিকটবর্তী তেওয়ারিপাড়াতে ছিল রামায়েত সাধুদের আশ্রম। ইন্দ্রাণীপীঠ দাঁইহাটেও রামায়েতি সাধনার আখড়া ছিল বলে ধারণা করা হয়। ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা একান্ন পীঠের একটি পীঠ। এই যোগাদ্যার অনুরূপে বর্ধমান জেলার খাপুর গ্রামে পূজিতা হন, আরেক যোগাদ্যা। তিনি রামায়েত পরম্পরার সাধুদের দ্বারা পূজিত হতেন। কথিত আছে, স্বয়ং মহাবীর হনুমান এই দেবীর প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার শাক্ত ভাবধারার সঙ্গেও যে রাম-সংস্কৃতির সহবাস ছিল, এই জনশ্রুতিই তার প্রমাণ বহন করে। রামায়েতি পরম্পরার একটি প্রতীক, ‘খুন্তি’-র ব্যবহার এখনও বিভিন্ন বৈষ্ণব পরম্পরায় পরিলক্ষিত হয়। ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এর রচয়িতা জয়ানন্দের পরিবার রামায়েত পরম্পরায় আশ্রিত ছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে মাতৃসাধক শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে জটাধারী নামে এক রামায়েত সাধু আসেন, সাল ১৮৬২ বা ৬৩। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে অষ্টধাতুর ‘রামলালা’ বিগ্রহ দেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর কাছ থেকে রামমন্ত্রে উপাসনা গ্রহণ করেন, সে এক অন্য ইতিহাস। শ্রীক্ষেত্রে যাওয়ার পথে বহু রামায়েতি সাধু আশ্রয় নিতেন বাংলায়। চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগে বাংলার বৈষ্ণব সাম্রাজ্য রামায়েতদের হাতেই ছিল, এ-কথা প্রায় প্রমাণিত।
রামায়ণ রচনায় বঙ্গীয় নারী
ষোড়শ শতক থেকে বিংশ শতাব্দী, ভারতের অন্যান্য নারীদের সঙ্গে বাংলার নারীসমাজেও চর্চিত ও রচিত হয়েছে রামায়ণের বিভিন্ন আঙ্গিক। মনসামঙ্গল রচয়িতা দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা চন্দ্রাবতী রচনা করেন রামায়ণ পালা। বাংলা বৈষ্ণব পদাবলীর চৌষট্টি পর্যায়ের মধ্যে রয়েছে ‘রাধাবিরহ’। জয়দেব থেকে বড়ুচণ্ডীদাস হয়ে এই পর্যায় ক্রমশ পদ-ঋদ্ধ হয়েছে। ঠিক তেমনই, সীতার দুঃখ-যন্ত্রণা-বিরহ নিয়ে বাংলা, মৈথিলি, মারাঠি, তেলুগু ভাষায় অখ্যাত গ্রামগঞ্জের নারীরা রচনা করেছেন অজস্র গাথা। তেমনই একটি সৃষ্টি, চন্দ্রাবতীর রামায়ণ, মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি বলা হয় তাঁকে। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দকে তাঁর মৃত্যুর সময়কাল ধরা হয়। ১২৯৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় সৌদামিনী দেবীর ‘অদ্ভূত রামায়ণ’। সেখানে গ্রন্থের প্রথমে উদ্ধৃত হয়েছে ‘রামকৃত সীতাস্তব’। সীতার শক্তিরূপ প্রত্যক্ষ করে স্বয়ং রাম এই স্তব রচনা করেছিলেন। এই স্তবে সীতাকে ‘রাবণান্তকরী’ নামে উল্লেখ করা হচ্ছে। এই গ্রন্থ রচনা করতে করতেই সৌদামিনী দেবীর অসুস্থ স্বামী পরলোকগমন করেন। তবু কবি লেখা ছাড়েননি, সম্পূর্ণ করেছেন, ভূমিকায় লিখেছেন,
“সৌদামিনী দেবী কহে করিয়া প্রণতি,
জীবনান্তে পদপ্রান্তে রেখো রঘুপতি।”
মুখপত্রে তিনি স্পষ্টই লিখেছেন, চার কন্যাকে নিয়ে তিনি আজ স্বামীহারা, অনাথা তবু ভিক্ষা অপেক্ষা এই পুস্তকের বিনিময় মূল্যই তাঁর অবলম্বন। সীতার দুঃখ, যন্ত্রণা, সহনশক্তি বাংলার ঘরে ঘরে মেয়েদের অনুপ্রেরণা। সংসার অনলে দগ্ধ হতে হতে তাঁরা স্মরণ করেন, সীতার পবিত্রতার কথা। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ দারিদ্র্যক্লিষ্ট বাংলার সংসারে এক জ্বলন্ত প্রবাদবাক্য, এ কথা বোধ করি আর স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না। হালফিলে সদ্যপ্রয়াতা শ্রীমতী নবনীতা দেবসেন নারীবাদী প্রথারই অনুবর্তন করে লিখেছেন, ‘সীতা থেকে শুরু’। কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘সীতায়ন’। বলাই বাহুল্য, রাধাবিরহ পর্যায়ে যেমন নিন্দিত হয়েছেন পুরুষপ্রধান শ্যাম, তেমনই এই নারীকেন্দ্রিক রামায়ণগুলিতেও নিন্দিত হয়েছেন, মর্যাদা পুরুষোত্তম রাম। বিরুদ্ধ ভাবে ভজনাও সনাতন সংস্কৃতির একটি সিদ্ধান্ত, ভারতীয় পরম্পরায় স্বীকৃত।
বঙ্গের শারদীয়া মহাপূজায় শ্রীরাম
কৃত্তিবাসী রামায়ণে শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক শারদীয়া দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান বাংলার শাক্ত ভাবধারার সাক্ষ্য বহন করে, এ-কথা অনস্বীকার্য। শ্রীরাম কর্তৃক ‘অকালবোধন’-এর পরম্পরা বাংলা আজও বহন করে চলেছে। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বিল্ববৃক্ষমূলে বোধনের প্রার্থনায় বলা হচ্ছে—
“রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ
অকালে ব্রহ্মনা বোধো দেব্যাস্ত্বয়ি কৃতঃ পুরা।
অহমপি-আশ্বিনে ষষ্ঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়ামি তে।”
অর্থাৎ, রাবণের বধের জন্য, রামের অনুগ্রহে ব্রহ্মার দ্বারা দেবী অকালবোধিতা হয়েছিলেন। আমিও সেই আশ্বিন ষষ্ঠীর সায়াহ্নে দেবীর বোধন করছি। কৃত্তিবাসও লিখেছেন অনুরূপ কথা,
“ইন্দ্রের শুনিয়া বাণী কন কমণ্ডলু-পাণি
উপায় কেবল দেবীপূজা।
তুমি পূজি যে চরণ জিনিলে অসুরগণ
বোধিয়া শরতে দশভুজা।”
…
“বিধাতা কহেন সার শুন বিধি দিই তার
কর ষষ্ঠী কল্পেতে বোধন।”
…
“বনপুষ্পে ফলমূলে গিয়া সাগরের কূলে
কল্প কৈলা বিধির বিচার।
পূজি দুর্গা রঘুপতি করিলেন স্তুতি নতি
বিরচিল চণ্ডীপূজা সার।”
কৃত্তিবাসী রামায়ণে দুর্গাপূজার বিস্তৃত বর্ণনা ও সূত্রোল্লেখ রয়েছে। প্রতিটি আচার আজও বাংলায় পালিত হয়। ‘আপনি গড়িয়া রাম মূরতি মৃন্ময়ী’—মৃন্ময়ী মূর্তির পূজা, অধিবাস, আমন্ত্রণ, নবপত্রিকা বাঁধন, সন্ধিপূজা, অষ্টোত্তর শত পদ্মপুষ্প দান, সবই বঙ্গীয় শারদীয়া পূজার অবিচ্ছেদ্য অংশ। শ্রীরামের ‘নাট্ট গীত’ সহ দুর্গাপূজা আজও বাংলায় উদ্যাপিত হয়। সন্ধিপূজার বিশেষ মাহাত্ম্যও বাংলায় লক্ষিত হয়। কথিত আছে, এই সন্ধিক্ষণেই দেবী স্বয়ং রামের ধনুকের জ্যা-তে প্রবেশ করেন। দশমীতে রাবণ বধ হয়, ‘দশমীতে পূজা করি, বিসর্জিয়া মহেশ্বরী, সংগ্রামে চলিলা রঘুপতি’। বাংলায় ‘বিজয়া’-দশমীর উল্লাস আসলে উৎসব শেষের উল্লাস নয়, রাবণবধ ও রামবিজয়ের উল্লাস। পণ্ডিতগণ বলেন, শ্রীরামের দুর্গাপূজার প্রমাণ কেবল কৃত্তিবাসী রামায়ণেই পাওয়া যায়। এ-কথা সত্য নয়। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, দেবীভাগবতম্ সহ মুখ্য পুরাণ ভিন্ন অন্যত্রও শ্রীরামের ভগবতী-আরাধনার সূত্র রয়েছে। কৃত্তিবাস সেই পৌরাণিক বচনসমূহই প্রকাশ করেছেন। বাল্মিকী রামায়ণে শ্রীরাম ঋষি অগস্ত্যের আদেশে, ‘আদিত্যহৃদয় স্তোত্রম্’ পাঠ করে সূর্যের স্তুতি করছেন। অন্যদিকে শাস্ত্র বলছে,
“গায়ত্রী ব্রহ্মরূপাতু সাবিত্রী বিষ্ণুরূপিণী।
সরস্বতী রূদ্ররূপা উপাস্যা-রূপ ভেদতে।।”
সনাতনী দ্বিজবৃন্দ কর্তৃক নিত্য সন্ধ্যা-উপাসনা সূর্যের এই তিন রূপের অনুধ্যানেই অনুষ্ঠিত হয়। প্রাতঃসন্ধ্যায় তিনি ব্রহ্মরূপা গায়ত্রী, মধ্যাহ্ন সন্ধ্যায় বিষ্ণুরূপা সাবিত্রী আর সায়ং সন্ধ্যায় তিনিই রূদ্ররূপা সরস্বতী। এখন, নিত্যানুষ্ঠান-পরায়ণ দ্বিজ পণ্ডিতগণ একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন, এই ত্রিমূর্তির উপাসনাই আদতে বঙ্গের শারদীয়া দুর্গাপূজা।
কাশীরাম দাস যখন বাংলায় মহাভারত রচনা করছেন, ঠিক সেই সময়ে কবি জগতরাম রায় আরেকখানি রামায়ণ রচনা করছেন, বাঁকুড়া জেলার ভুলুই গ্রামে বসে। রামায়ণ রচনা শেষে শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজা নিয়ে ‘দুর্গাপঞ্চরাত্রি’ নামে একটি খণ্ডকাব্যও রচনা করেন, দুর্গাপূজার প্রতিটি দিনের পৃথক বর্ণনা সহ। তাঁর পুত্র রামপ্রসাদ রায়ের লেখনীতেই পাওয়া যায়, “পিতা জগতরাম মোর রাম পরায়ণ। যেঁহ কাব্য রচিলা অদ্ভূত রামায়ণ।”
বাংলায় শ্রীরামের চিহ্ন, মন্দির ও উপাসনা
বাংলার দিকে দিকে ছড়িয়ে রয়েছে রাম-সংস্কৃতির অজস্র চিহ্ন, বিগ্রহ, মন্দির। কোথাও তিনি শালগ্রামরূপে, কোথাও তিনি সীতার সঙ্গে, কোথাও মহাবীর হনুমানের সঙ্গে, কোথাও লক্ষ্মণ সহ সপরিবারেই পূজিত হচ্ছেন আজও। যেমন, কেতুগ্রামে কবি চণ্ডীদাস পূজিত ‘রঘুনাথ’ শিলার সন্ধান পাওয়া যায়। কামারপুকুরে রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কূলদেবতা রঘুনাথ শিলা। মঙ্গলকোট থানার বুঁইচি গ্রামে রামের উপাসনার চিহ্ন পাওয়া গেছে। এছাড়াও বাংলার বহু স্থানে রামনবমীর উৎসব, রথযাত্রা প্রভৃতি সাড়ম্বরে পালিত হয়। যেমন, পূর্ব-বর্ধমানের গুহগ্রাম। এখানে প্রতিষ্ঠিত আছেন শিলাময় শ্রীরামচন্দ্র ও ধাতুময়ী সীতামায়ের বিগ্রহ। রামনবমীতে ধুমধাম করে অধিবাস, পুজো ও দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। বাঁকুড়ায় বিষ্ণুপুরের জোড়-বাংলা, শ্যামরায় মন্দির, রাধাশ্যম মন্দির ইত্যাদি প্রাচীন স্থাপত্যে রামায়ণের কাহিনি টেরাকোটার মাধ্যমে চিত্রিত রয়েছে। এছাড়াও ইছারিয়া ও বেলুট-গোবিন্দপুরে রয়েছে প্রাচীন রামমন্দির। কথিত আছে, বেলুট-গোবিন্দপুরের এই রামমন্দিরে প্রণাম জানিয়ে চৈতন্যদেব সন্ন্যাস নিতে গিয়েছিলেন। কেন্দুলিতে জয়দেবের জন্মস্থানে তিনশতাধিক বর্ষপ্রাচীন রাধাবিনোদ মন্দিরে অঙ্কিত রয়েছে জটায়ুর সীতা-উদ্ধারের কাহিনি। বাঁকুড়ার দত্তপাড়ার নবরত্ন দামোদর মন্দিরে রামরাবণের যুদ্ধ টেরাকোটার মাধ্যমে চিত্রিত হয়েছে। হুগলির গুপ্তিপাড়ায় রামনবমীর মেলা প্রায় চারশতাধিক বর্ষপ্রাচীন। প্রসঙ্গত, গম্ভীরা লোকনৃত্যে রামায়ণের বিভিন্ন মুখোশ দেখা যায়। কলকাতাতেও জোড়াসাঁকোর দাঁ-দের বাড়ির পেছনের দিকে রয়েছে পুরনো এক রাম-মন্দির। রাজ-দরবারে আসীন শ্রীরাম-সীতা ও সেবারত লক্ষ্মণ ও হনুমানের অপূর্ব অষ্টধাতুর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত এখানে। নিত্যপূজাও হয়। কলকাতার কালীঘাটে শ্যামরাই মন্দির থেকে রামনবমীর মিছিলে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহই অংশ নেন। হাওড়ার ‘রামরাজাতলা’-র রামনবমীর উৎসবও সুপ্রসিদ্ধ। নদীয়ার শিবনিবাস এবং শ্রীরামপুরেও পূজিত হন শ্রীরাম। শান্তিপুরে রথযাত্রা হয় শ্রীরামচন্দ্রের।
১৮৯৬ সালে ‘গ্রামরত্ন ফুলিয়া’-তে কবি কৃত্তিবাসের জন্মভিটে আবিষ্কার করেন কবি নবীনচন্দ্র সেন। ১৯১৫ সালে বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উপস্থিতি ও উদ্যোগে কবির জন্মভিটের পুনঃস্থাপন হয়।
চৈতন্য-অধ্যায়ে শ্রীরাম
‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।’
‘কৃষ্ণকেশব কৃষ্ণকেশব কৃষ্ণকেশব পাহি মাম্।
রামরাঘব রামরাঘব রামরাঘব রক্ষ মাম্।।’
এই দুটি মহামন্ত্র চৈতন্য প্রচার করেছেন আপামর জনসাধারণে। প্রতিটি মন্ত্রে কৃষ্ণনামের সমান্তরালে রামের শ্রীনাম সমোচ্চারিত। চৈতন্য-পরিকর মুরারিগুপ্তের ইষ্ট ছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। চৈতন্য তাঁকে তাঁর ইষ্টসাধনাই করিয়েছেন এবং ইষ্টদর্শনও করিয়েছেন। চৈতন্যলীলার ব্যাস বৃন্দাবন ঠাকুরের ‘চৈতন্য ভাগবত’-এ রামায়ণের নাটগানের উল্লেখ রয়েছে। বালক নিত্যানন্দ লক্ষ্মণ সেজেছেন সেখানে। শক্তিশেলের আঘাতে ভাবের আবেশে নিত্যানন্দ মূর্ছিত হয়ে পড়েছেন, তাঁকে বহু চেষ্টা করেও স্বভাবস্থ করা যাচ্ছে না—এমনটাই বর্ণনা করেছেন বৃন্দাবন ঠাকুর,
‘কোন শিশু বোলে,—“মুঞি আইলু রাবণ
শক্তিশেল হানি এই, সম্বর লক্ষ্মণ।”
এত বলি পদ্মপুষ্প মারিল ফেলিয়া।
লক্ষ্মণের ভাবে প্রভু পড়িলা ঢলিয়া।।
মূর্চ্ছিত হইল প্রভু লক্ষ্মণের ভাবে।
জাগায় ছাওয়াল সব, তবু নাহি জাগে।’
নিত্যানন্দের রামলীলাভিনয়ের আরও প্রসঙ্গ পাওয়া যায়,
‘কোনদিন নিত্যানন্দ সেতু বন্দ করে।
বানরের রূপ সব শিশুগণ ধরে।’
অনুরূপে, চৈতন্যযাত্রার শেষ অঙ্কে মহাপ্রভুও পুরীধামে থাকাকালীন বিজয়া দশমীর উৎসবে ‘রাবণবধ’ পালায় অভিনয় করেছিলেন বলে জানা যায়। এই নিত্যানন্দ প্রভুকেই মহাপ্রভু ষড়ভুজ রূপ দেখিয়েছিলেন। রাম, কৃষ্ণ ও গৌরাঙ্গ তনুর সমন্বয়ে রচিত সেই মূর্তি। লোচনদাস ঠাকুরের চৈতন্যমঙ্গল কাব্যে—
‘রাম অবতার তুমি ধনুক হয়্যা।
রহিলে আমার হাতে দুষ্টের লাহিয়া।।
কৃষ্ণ অবতারে বংশী হয়্যা মোর হাতে।
মোহিত করিলা তুমি অখিল সংসারে।।
এবে দণ্ড হয়্যা মোর আইলা করেতে।
কলিযুগে পাষণ্ড-দলন হেতু রীতে।’
বিষ্ণুপুরে কাদাকুলি অঞ্চলে বাগীশপাড়ায় রয়েছে এই বিগ্রহের চিহ্ন।
চৈতন্যজীবনী থেকে আরও জানা যায়, রামায়ণ কেবলই হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষের প্রিয় ছিল না, অন্য ধর্মের মানুষের কাছেও তা জনপ্রিয় হয়।
“যবনেহ যার কীর্তি শ্রদ্ধা করি শোনে।
ভজ হেন রাঘবেন্দ্র প্রভুর চরণে।।”
ইতিহাসও সেই কথাই বলে। মুসলমান ও পাঠান রাজত্বে বাংলায় বহু কাব্য, মহাকাব্য রচিত হয়েছে, অনূদিত হয়েছে, তার মধ্যে একাংশ রাজ-উৎসাহে। শোনা যায়, কৃত্তিবাস কবিও গৌড়ের শাসক বরবক শাহ দ্বারা সম্মানিত হয়েছিলেন, তাঁর রামায়ণ কাব্যের জন্য। কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী প্রমুখেরা মহাভারতের অনুবাদ করেছিলেন রাজ-অনুগ্রহে। এই সময়ে এই সমস্ত মহাকাব্যের কদর ও শ্রদ্ধা ছিল। পরবর্তীকালে মোঘল আমলে বাংলায় বারো-ভুঁইয়ার শাসনব্যবস্থায় এসব প্রচলন মুছে গেল, থেকে গেল লুণ্ঠনের সংস্কার। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষের ধর্মজীবনেও পরিবর্তন এসেছিল চৈতন্যের হাত ধরে। তবে রাম-ভাবনাকে তিনি মুছে দিতে চাননি বা দেননি, তার প্রভূত প্রমাণ রয়েছে। শত শত মশালবাহী মানুষের মিছিলে চৈতন্যের ‘চাঁদ কাজি উদ্ধার’ লীলা কি শ্রীরামের ক্ষাত্রতেজের উত্তরসূরিতা নয়?
রামকৃষ্ণ ভাবধারায় শ্রীরাম
১৮৩৬ সালে বাংলার হুগলি জেলার কামারপুকুরে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীরামকৃষ্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের গৃহদেবতা ছিলেন রঘুবীর। পরিবারের নারীপুরুষ সকলের নামের সঙ্গেই ‘রাম’ শব্দটি যুক্ত ছিল, মাণিকরাম, ক্ষুদিরাম, অভয়রাম, হৃদয়রাম, রামশীলা ইত্যাকার। শ্রীরামকৃষ্ণের পিতা ক্ষুদিরাম ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ নিষ্ঠাবান পণ্ডিত ও রঘুবীর-অন্তপ্রাণ। কামারপুকুরে সে-সময় রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি পালা, যাত্রাগান ও নিয়মিত পাঠের প্রচলন ছিল, সেকথা শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনী থেকে জানা যায়। বালক শ্রীরামকৃষ্ণও তাতে অংশ নিতেন ও গানে-পাঠে পটু ছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে রাণী রাসমণি কর্তৃক জগদীশ্বরীর মন্দির প্রতিষ্ঠা হলে দাদা রামকুমারের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ সেখানে গেলেন। মাতৃসাধনায় নিজেকে সমর্পণ করলেন। রাণী রাসমণির কুলদেবতাও ছিলেন রঘুবীর। জানবাজারে রাণীর বাসগৃহে রঘুবীরের রথযাত্রার জন্য রূপোর রথ নির্মিত হয়েছিল, যে রথযাত্রা আজও পালিত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট একবার জটাধারী নামের এক রামায়েতি সাধু আসেন। তিনি রামকৃষ্ণকে রামলালা নামের রামের বাল্যরূপের বিগ্রহ দেন। তাঁর নিকটেই শ্রীরামকৃষ্ণ দাস্যভাবে রামসাধনা করেন। মহাবীর হনুমানের আবেশে রামদর্শনের আকুতি দেখা যায় শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে। কথিত আছে, এই সময় তিনি পঞ্চবটীর গাছের শাখায় চড়ে বানরের মতো ‘হুপ হুপ’ শব্দ করতেন মুখে। শ্রীরামসীতার দর্শন হয় তাঁর। পরবর্তীকালে তাঁর সহধর্মিনী শ্রীশ্রীমা-এর হাতের একটি ‘ডায়মন-কাট’ বালা বানিয়ে দেন। শ্রীরামসাধনার সময় সীতাদেবীর হাতে তিনি অনুরূপ বালা দর্শন করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলায় তাঁর নিকটতম পার্ষদ স্বামী বিবেকানন্দকে নিজ স্বরূপ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “যে রাম, যে কৃষ্ণ, ইদানীং তিনি এই শরীরে রামকৃষ্ণ।” প্রসঙ্গত, স্বামী বিবেকানন্দ নিজেও বাল্যকাল থেকে রামায়ণের অনুরাগী ছিলেন। পরবর্তীতে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে শ্রীরামের সাধনাও করেছিলেন বলে শোনা যায়। পরে তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে শ্রীরামের ক্ষাত্রবীর্যের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহাবসানের পর বেলুড় মঠ স্থাপিত হলে সেখানে নিত্য একাদশী তিথিতে অষ্টোত্তরশতনাম-রামায়ণ সংকীর্তন চালু হয়, আজও সেই পরম্পরা অক্ষুণ্ণ রয়েছে। জানা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ স্বামী ব্রহ্মানন্দ বারাণসীর রামকৃষ্ণ মঠে রামনাম চলাকালীন নামশ্রবণরত মহাবীরজীর দর্শনলাভ করেছিলেন।
রবীন্দ্রভাবনায় রামায়ণ
রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলার স্মৃতিতে বারবার উঠে এসেছে রামায়ণের স্মৃতি। ‘ছেলেবেলা’, ‘জীবনস্মৃতি’ প্রমুখ গ্রন্থে কবি সেকথা লিখেছেন। বাল্যকালে কিশোর চট্টোপাধ্যায়ের রামায়ণ গান তাঁকে বিশেষ প্রভাবিত করেছিল। কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়ে তিনি বনবাসী রাম-সীতার দুঃখে কাঁদতেন। রামায়ণের কাহিনির সারটি গ্রহণ করে বাংলা সাহিত্যে তিনি বহু সমৃদ্ধ রচনা সৃষ্টি করেছেন। ‘বাল্মিকী প্রতিভা’, ‘কালমৃগয়া’ প্রভৃতি নাট্য, ‘অহল্যার প্রতি’, ‘পতিতা’, ‘পুরস্কার’ প্রভৃতি কবিতায় রামায়ণী কথারই সারমর্ম লক্ষিত হয়। ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থ ও ‘সহজপাঠ’ গ্রন্থে শৈশবকে রামায়ণের গল্পে মজিয়েছেন। যোগীন্দ্রনাথ বসুর লেখা ‘সরল কৃত্তিবাস’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন,
“এতকাল আমাদের দেশের যে কেহ অক্ষর মাত্র পড়িতে জানিত, কৃত্তিবাসের রামায়ণ এবং কাশীরামদাসের মহাভারত না পড়িয়া ছাড়িত না; যাহার অক্ষরবোধ ছিল না, সে অন্যের মুখ হইতে শুনিত। এই রামায়ণ, মহাভারত আমাদের সমস্ত জাতির মনের খাদ্য ছিল; এই দুই মহাগ্রন্থই আমাদের মনুষ্যত্বকে দুর্গতি হইতে রক্ষা করিয়া আসিয়াছে। আজকাল আমরা যাহাকে শিক্ষিত সম্প্রদায় বলি, সেই সমাজে এই দুই গ্রন্থ এখন আর কেহ পড়ে না। অথচ জনসাধারণের মধ্যে এখনও এই দুই গ্রন্থের আদর রহিয়াছে।”
এই বইটির প্রসঙ্গেই কবিগুরু আবারও পরবর্তীকালে বলেছিলেন,
“কৃত্তিবাসের রামায়ণ যদি বাঙালি ছেলেমেয়েরা না পড়ে তবে তার চেয়ে শোচনীয় আশঙ্কা আমাদের পক্ষে আর কিছু হতে পারে না।”
বর্তমানে যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান গাইছেন গলা খুলে, রাবীন্দ্রিক চেতনার কেতন উড়াচ্ছেন সদর্পে, তাঁরাও মন্তব্য করছেন, ‘রাম বহিরাগত’।
নাম-প্রবাদে শ্রীরাম
আমরা ছোটবেলা থেকেই রামায়ণ সম্পর্কিত নানান প্রবাদ, ছড়া শুনে এসেছি। পরিবার পরম্পরায় এগুলি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বাহিত হচ্ছে। ভুতের ভয় দূর করতে যেমন, ‘ভুত আমার পুত, পেত্নি আমার ঝি, রাম-লক্ষ্মণ সাথে আছে করবি আমার কী!’ অথবা, সবকিছু বর্ণনা করার পরেও যখন শ্রোতা অসংলগ্ন কথা বলে, তখন বলা হয়, “সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা কার বাপ!” অথবা কারও মুখে অপ্রত্যাশিত কথা শুনলে বলা হয়, “ভুতের মুখে রামনাম!” কিছু গোনা শুরু হলে ‘এক’-এর বদলে ‘রাম’ বলা হয়, রাম, দুই, তিন, চার ইত্যাদি। এতে নাকি অক্ষয় হয় সে জিনিস। রামের সেতুবন্ধে নাকি ক্ষুদ্রাকার কাঠবেড়ালিও সাহায্য করেছিল, তাই শ্রীরাম তাদের গায়ে হাত বুলিয়েছিলেন স্নেহবশত। কাঠবেড়ালির গায়ের ওই লম্বা ডোরাকাটা দাগগুলি নাকি শ্রীরামের আঙুলের ছাপ—এমনই বিশ্বাস বাঙালির। আর পাপমোক্ষণের উপায়, ‘মরা’ থেকে ‘রাম’, দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মিকী এ সকল আখ্যানই তো বাংলার অতিপরিচিত।
বাংলায় অজস্র নাম আছে রামের নামে। ব্যক্তিনাম ও স্থাননাম উভয়ই। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় চারশতাধিক গ্রামের নাম আছে শ্রীরাম সম্পর্কিত।
রামায়ণ গান
বাংলার লোক-আখ্যানে বাল্মিকী রামায়ণ ও কৃত্তিবাসী রামায়ণ উভয়েরই প্রভাব রয়েছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণের বহু আগে থেকেই বাংলায় রামায়ণের প্রভাব ছিল, সে-কথা এই আলোচনা থেকেই স্পষ্ট। সংস্কৃত রামায়ণের যথেষ্ট প্রতিপত্তি না থাকলে কৃত্তিবাস অনুবাদে প্রবৃত্ত হতেন না। কৃত্তিবাসের সবচেয়ে নিখুঁত প্রভাব হয় বাংলার নাট্য-গীতি সংস্কৃতিতে। বাংলার নাট্য সংস্কৃতির প্রাচীনতা নতুন করে বলবার নয়। মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ কাব্যে ‘রামায়ণ নাট’-এর উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে দৈত্যরাজসভায় পূর্ণাঙ্গ রামায়ণ মঞ্চস্থ হওয়ার কথা বলা আছে। মধ্যযুগে সৃষ্ট রামলীলা বা রামযাত্রায় ‘সীতাহরণ’, ‘রামবিবাহ’, ‘দস্যু রত্নাকর’, ‘সীতার বনবাস’ প্রভৃতি পালাই বেশি দেখা যেত। পাঁচালিগানে রামায়ণের কথা গেয়ে বিখ্যাত করেছিলেন যিনি, তিনি পাঁচালিসাহিত্যের রূপকার ‘পাঁচালিকার’ দাশরথি রায় বা দাশু রায়। ‘শ্রীরামচন্দ্রের বিবাহ’, ‘শ্রীরামচন্দ্রের বনগমন ও সীতাহরণ’, ‘মায়াসীতা বধ’, ‘তরণীসেনবধ’, ‘মহীরাবণবধ’, ‘রাবণবধ’, ‘শ্রীরামচন্দ্রের দেশাগমন’, ‘লবকুশের যুদ্ধ’ প্রভৃতি নানা বিখ্যাত পালায় তিনি গ্রামেগঞ্জে, নগরে সর্বত্র মাতিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়াও ছিলেন, ঠাকুরদাস দত্ত, ব্রজমোহন রায়, রসিকলাল চক্রবর্তী, আনন্দ অধিকারী প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্বেরা। পরবর্তীকালে বাংলা যাত্রায় রামায়ণের ধারাকে অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন, মতিলাল রায়।
উপসংহার
বঙ্গে রাধাকৃষ্ণের প্রভাবে ও অন্যান্য নানা কারণে রামসংস্কৃতি ফল্গুধারার মতো খানিকটা অন্তঃসলিলা হলেও বাংলায় এই সংস্কৃতি বহিরাগত, এ-কথা কখনওই স্বীকার্য নয়। বাংলায় বীররসের প্রভাব বরাবরই কম। মধুর ভাব, কোমল ভাব, শৃঙ্গার রস, করুণ রস, বাৎসল্য রস এসবেরই প্রভাব খাটে এখানে। কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণ বা দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণের তুলনায় ব্রজবিহারী, গোষ্ঠবিহারী, যশোদানন্দন, রাধাহৃদয়রমণ শ্রীকৃষ্ণের প্রভাবই বঙ্গে অধিক। ক্ষাত্রদীপ্ত শ্রীরামও বাংলায় অনেক কমনীয় হয়ে গেছেন। কিন্তু বর্তমানে সময় এসেছে, কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধহোতা দ্বারকাপতি শ্রীকৃষ্ণের পাশাপাশি রাবণান্তক শ্রীরামের ভজনা করার। উভয় পুরুষোত্তমের যে ক্ষাত্রতেজ মহাকাব্যে বর্ণিত হয়েছে, সেই রূপেই তাঁকে ভজনা করার সময় এসেছে।
অধুনা বঙ্গে, শ্রীরামের জয়ধ্বনি নিয়ে বহু বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। শ্রীরামের জন্মভূমি উদ্ধার ও পুনঃস্থাপন নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। এহেন প্রেক্ষাপটে, একটি বিষয়ই প্রমাণ করা যায় যে চিরন্তনী সংস্কৃতি সংরক্ষণের অহেতুক বিরোধিতা, ইতিহাসের যথেচ্ছ বিকৃতিকরণ, একটি সহজ দর্শনের অপব্যাখ্যাই আধুনিকমনস্কতা প্রমাণ করার হাতিয়ার। ভারতভূমির সঙ্গে সম্পর্কহীন মতবাদের নিরিখে যুগস্রোতা সংস্কৃতির যেনতেন প্রকারেণ তুল্যমূল্য নিরূপণই আধুনিকতার পথে প্রথম এবং অতিপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। রত্নপ্রসবা বাংলার বুকে হাজারো যুগপুরুষ সময়ের সঙ্গে, যুগের সঙ্গে আমাদের প্রাচীনতাকে সংস্কার করে দিয়ে গেছেন, যুগোপযোগী করে দিয়ে গেছেন—আমরা সে-সকল চোখে দেখতে পাই না। আমরা সর্বহারার যাত্রাপালা দেখে দুঃখে বুক ভাসাই কিন্তু এই বাংলাতেই লোকপ্রচলিত রামায়ণের একটি কাহিনি বিশ্লেষণ করার সময় পাই না। গল্পটি এরূপ, একবার সীতাদেবী শ্রীরামের কাছে আর্জি জানালেন, রামরাজ্যে শ্রেণীবৈষম্য থাকবে না, সকলকে ধনী করে দিতে হবে। শ্রীরাম প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্ত্রীর অনুগ্রহে তা’ই করলেন। ফল কী হল, কিছুদিনের মধ্যে রাজ্যে কাপড় বোনার লোক নেই, বাড়ি তৈরির ঘরামি নেই, রাজদরবারে কর্মচারী নেই, খাবার তৈরির লোক নেই, চাষবাসের লোক নেই, বাজারে বিক্রেতা নেই। সীতাদেবীর মাথার উপরে ছাদ ভেঙে যখন বৃষ্টির জল পড়তে শুরু করল, তখন তিনি রামচন্দ্রের কাছে গিয়ে স্বীকার করলেন নিজের ভুল। শ্রীরামচন্দ্র সব পূর্ববৎ করে দেওয়ার পাশাপাশি সীতাদেবীর কাছে অঙ্গীকার করলেন, যে-যে জীবিকাতেই থাকুক, সকলকে তিনি সম-মর্যাদায় পালন ও রক্ষা করবেন। এই সৌন্দর্য আমাদের মতো আধুনিক দার্শনিকদের চক্ষুগোচর হয় না। আমরা বলি, ‘জয় শ্রীরাম’ কেন, ‘জয় সীতারাম’ নয় কেন, আমরা তো একা কাউকে পুজো করি না? কিন্তু আমরা ভুলে যাই, ‘শ্রী’ শব্দ বৈকুণ্ঠবাসিনীর স্বয়ংদ্যোতক। রমা অর্থাৎ সীতাদেবীসহ-ই শ্রীরামের জয়ধ্বনি করা হচ্ছে। আমরা বিস্মৃত হই, প্রখ্যাত শিল্পী নন্দলাল বসু যখন আমাদের ভারতীয় সংবিধানের চিত্রণ করলেন, তখন তাতে মহাভারতের পাশাপাশি রামায়ণের নানা কাহিনিও চিত্রিত হল। ১৯৯৩ সালে, রামমন্দির সংক্রান্ত একটি মামলায়, এলাহবাদ উচ্চ ন্যায়ালয় বিবৃত করেছিলেন, রাম কেবল পৌরাণিক অতিকথামাত্র নয়, শ্রীরামের সাংবিধানিক সত্তা এবং ভারতীয় সংস্কৃতিতে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। শ্রীরামমন্দিরের পুনরুদ্ধার ও পুনর্নিমাণের উদ্যোগ সেই নিরবচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক পরম্পরার ধারাকে অক্ষুণ্ণ রেখেছে। যে-কোনও পরিস্থিতিতে এর প্রয়োজন আছে। যে-জাতির মূলানুগ সংস্কৃতি বেঁচে থাকে, সেই জাতিই সভ্যতার বুকে অমরতা লাভ করে।